পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ኢ99br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী দান করো যে, কোনো কর্মপ্রণালীতে নয়, রাষ্ট্ৰতন্ত্রে নয়, বাণিজ্যব্যবস্থায় নয়, যুদ্ধ-অস্ত্রের নিদারুণতায় e তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি । নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায় । Ne SwoS8 চরকা চরকা-চালনায় উৎসাহ প্ৰকাশ করি নি। অপবাদ দিয়ে আচার্য প্ৰফুল্লচন্দ্ৰ আমাকে ছাপার কালিতে লাঞ্ছিত করেছেন । কিন্তু দণ্ড দেবার বেলাতেও আমার পরে সম্পূর্ণ নির্মম হতে পারেন না বলেই আচার্য ব্ৰজেন্দ্ৰনাথ শীলকেও আমার সঙ্গে এক কলঙ্কের রসায়নে মিল করিয়েছেন । এতে আমার ব্যথা দূর হল, তা ছাড়া একটা অত্যন্ত পুরোনো কথার নতুন প্রমাণ জুটল। এই যে, কারও সঙ্গে কারও বা মতের মিল হয়, কারও সঙ্গে বা হয় না । অর্থাৎ, সকল মানুষে মিলে মৌমাছির মতো একই নমুনার চাক বাধবে, বিধাতা এমন ইচ্ছে করেন নি । কিন্তু সমাজবিধাতারা কখনো কখনো সেইরকম ইচ্ছা করেন । তারা কাজকে সহজ করবার লোভে মানুষকে মাটি করতে কুষ্ঠিত হন না । তারা ছাটাই-কলের মধ্যে মানুষ-বনস্পতিকে চালিয়ে দিয়ে ঠিক সমান মাপের হাজার হাজার সরু সরু দেশলাই কাঠি বের করে আনেন । বনাদ্রিব্যকে এরকম পণ্যদ্রব্য করলে বনদেবতারা চুপ করে থাকেন, কিন্তু মানুষের বুদ্ধিকে কাজের খাতিরে মৌমাছির বুদ্ধি করে তুললে নারায়ণের দরবারে হিসাবনিকাশের দিনে জরিমানায় দেউলে হবার ভয় আছে | ছোটো বয়সে জগন্নাথের ঘাটে জলযাত্রার প্রয়োজনে যখন যেতেম, নানা পান্সির মাঝি হাত ধরে টানাটানি করত । কিন্তু কোনো একটার 'পরে যখন অভিরুচির পক্ষপাত প্ৰকাশ করা যেত তখন সেজন্যে কারও কাছ থেকে শাসনভয় ছিল না । কেননা পান্সি ছিল অনেক, যাত্রী ছিল অনেক, তাদের গম্যস্থানও ছিল অনেক । কিন্তু, যদি দেশের উপর তারকেশ্বরের এমন একটা স্বপ্ন থাকত যে, তারণের জন্যে শুধু একটিমাত্র পান্সিই পবিত্র, তবে তার প্রবল পাণ্ডাদের জবরদস্তি ঠেকােত কে । এ দিকে মানবচরিত্র ঘাটে দাড়িয়ে কেঁদে মরত, ওরে পালোয়ান, কুল যদি-বা একই হয়, ঘাট যে নানা- কোনোটা উত্তরে কোনোটা দক্ষিণে । শাস্ত্রে বলেন, ঈশ্বরের শক্তি বহুধা । তাই সৃষ্টিব্যাপারে পঁাচ ভূতে মিলে কাজ করে । মৃত্যুতেই বিচিত্র ভূত দৌড় মারে ; প্রলয়ে সব একাকার । মানুষকে ঈশ্বর সেই বহুধা শক্তি দিয়েছেন, তাই মানবসভ্যতার এত ঐশ্বৰ্য । বিধাতা চান মানবসমাজে সেই বহুকে গেথে গেঁথে সৃষ্টি হবে ঐক্যের ; বিশেষফললুব্ধ শাসনকর্তারা চান, সেই বহুকে দ’লে ফেলে পিণ্ড পাকানো হবে সাম্যের । তাই সংসারে এত অসংখ্য এককালের মজুর, এক-উদি-পরা সেপাই, এক দলের দড়িতে বাধা কলের পুতুল । যেখানে মানুষের মনুষ্যত্ব জুড়িয়ে হিম হয়ে যায় নি। সেখানেই এই হামানদিস্তায়-কোটা সমীকরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছেই। কোথাও যদি সেই বিদ্রোহের লক্ষণ না থাকে, যদি দেখি সেখানে হয় প্রভুর চাবুকে নয় গুরুর অনুশাসনে মানুষকে অনায়াসেই একই ধূলিশয়নে অতি ভালোমানুষের মতো নিশ্চল শায়িত রাখতে পারে, তা হলে সেই 'দৃষ্টিহীন নাড়ীক্ষীণ হিমকলেবর দেশের জন্যে শোকের দিন এসেছে বলেই জানিব । আমাদের দেশে অনেকদিন থেকেই সমীকরণের অলক্ষণ বলবান । এই মরণের ধর্মই আমাদের দেশে প্রত্যেক জাতের প্রত্যেক মানুষের পরেই এক-একটি বিশেষ কাজের বরাত দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কানে এই মন্ত্র যে, সৃষ্টির প্রথম দরবারে তাদের আদিপুরুষ একটিমাত্র বিশেষ মজুরির বায়না নিয়ে তাদের চিরকালকে বাধা দিয়ে বসে আছে। সুতরাং কাজে ইস্তফা দিতে গেলেই সেটা হবে অধৰ্ম ।