পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ぐう8ご রবীন্দ্র-রচনাবলী ’পরে এত অশ্রদ্ধা ? গুপী বলে আমাদের এক পশ্চিমদেশী বোহারা ছিল । ছেলেবেলায় তার কাছে গল্প শুনেছিলুম যে, যখন সে পুৱীতীর্থে গিয়েছিল, জগন্নাথের কাছে কোন খাদ্য ফল উৎসর্গ করে দেবে এই নিয়ে তার মনে বিষম ভাবনা উপস্থিত হল । সে বার বার মনে মনে সকল রকম খাবার যোগ্য ফলের ফর্দ আউড়িয়ে যেতে লািগল । কোনোটাতেই তার মন সায় দিলে না । অবশেষে হঠাৎ মনে পড়ে গেল বিলিতি বেগুন । তখনই তার দ্বিধা গেল ঘুচে, জগন্নাথকে দিয়ে এল বিলিতি বেগুন, শেষ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে তার পরিতাপ রইল না । সব চেয়ে সহজ দেবতার কাছে সব চেয়ে কম দেওয়ার দাবি মানুষের প্রতি সব চেয়ে অন্যায় দাবি । স্বরাজসাধনের নাম করে তেত্ৰিশ কোটি লোককে চরকা কাটতে বলা জগন্নাথকে বিলিতি বেগুন দেওয়া । আশা করি, ভারতবর্ষে তেত্ৰিশ কোটি গুপী নেই । বড়ো যখন ডাক দেন তখন বড়ো দাবি করেন, তখন মানুষ ধন্য হয় । কেননা, মানুষ তখন আপনি তুচ্ছতার মাঝখানে চমকে জেগে ওঠে, বুঝতে পারে সে বড়ো । আমাদের দেশ আচারনিষ্ঠতার দেশ বলেই দেবতার চেয়ে পাণ্ডার পা-পুজোর পরে আমাদের ভরসা বেশি । বাহিরকে ঘুষ দিয়ে অন্তরকে তার দাবি থেকে বঞ্চিত করতে পারি, এমনতরো বিশ্বাস আমাদের ঘোচে না । আমরা মনে করি, দড়ির উপরে যদি প্ৰাণপণে আস্থা রাখি তা হলেই সে নাড়ী হয়ে ওঠে । এই বাহ্যিকতার নিষ্ঠা মানুষের দাসত্বের দীক্ষা | আত্মকর্তৃত্বের উপর নিষ্ঠ হারাবার এমন সাধনা আর নেই। এমন দেশে দেশ-উদ্ধারের নাম করে এল চরকা | ঘরে ঘরে বসে বসে। চরকা ঘোরাচ্ছি। আর মনে মনে বলছি, স্বরাজ-জগন্নাথের রথ এগিয়ে চলছে। ঘোর পুরাতন কথাটাকে আজ নতুন করে বলতে হচ্ছে যে, স্বরাজের ভিত বাহ্য সাম্যের উপর নয়, অন্তরের ঐক্যের উপর । জীবিকার ক্ষেত্রে এই আন্তরিক ঐক্যের মস্ত একটা জায়গা আছে । বস্তুত ঐক্যটা বড়ো হতে গেলে জায়গাটা মস্ত হওয়াই চাই । কিন্তু, মানুষের সমগ্র জীবনযাত্রা থেকে তার একটিমাত্র ভগ্নাংশকে ছাড়িয়ে তারই উপর বিশেষ ঝোক দিলে সুতোও মিলবে, কাপড়ও মিলবে, ভারতবর্ষে ধর্মের ক্ষেত্রে সকলের মিল হওয়া সম্ভব নয় ; আর রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রে.সকলেই মিলবে এমন চর্চা এখানে কোনােদিন ছিল না, সবে এর আরম্ভ হয়েছে— সাধারণের মনকে সত্য ভাবে অধিকার করতে অনেক দেরি হবে । এইজন্যেই জীবিকার ভিতের উপরে একটা বড়ো মিলের পত্তন করবার দিকেই আমাদের মন দিতে হবে । জীবিকার ক্ষেত্র সব চেয়ে প্রশস্ত, এখানে ছোটো-বড়ো জ্ঞানী-অজ্ঞানী সকলেরই আহবান আছে- মারণেরই ডাকের মতো এ বিশ্বব্যাপী । এই ক্ষেত্র যদি রণক্ষেত্র না হয়- যদি প্ৰমাণ করতে পারি, এখানেও প্রতিযোগিতাই মানবশক্তির প্রধান সত্য নয়, সহযোগিতাই প্রধান সত্য- তা হলে রিপুর হাত থেকে, অশান্তির হাত থেকে মস্ত একটা রাজ্য আমরা অধিকার করে নিতে পারি । তা ছাড়া এ কথাও মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষে গ্রামসমাজে এই ক্ষেত্রে মেলবার চর্চা আমরা করেছি। সেই মিলনের সূত্র যদি-বা ছিড়ে গিয়ে থাকে, তবু তাকে সহজে জোড়া দেওয়া চলে, কেননা আমাদের মনের স্বভাবটা অনেকটা তৈরি হয়ে আছে । ব্যক্তিগত মানুষের পক্ষে যেমন জীবিকা, তেমনি বিশেষ দেশগত মানুষের পক্ষে তার রাষ্ট্রনীতি । দেশের লোকের বা দেশের রাষ্ট্রনায়কদের বিষয়বুদ্ধি এই রাষ্ট্রনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে । বিষয়বুদ্ধি হচ্ছে ভেদবুদ্ধি । এ পর্যন্ত এমনিই চলছে । বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্র একান্তভাবে স্বকীয় স্বার্থসাধনের যে আয়োজনে ব্যাপৃত সেই তার রাষ্ট্রনীতি । তার মিথ্যা দলিল আর অস্ত্রের বোঝা কেবলই ভারী হয়ে উঠছে। এই বোঝা বাড়াবার আয়োজনে পরস্পর পাল্লা দিয়ে চলেছে ; এর আর শেষ নেই, জগতে শান্তি নেই। যেদিন মানুষ স্পষ্ট করে বুঝবে যে, সর্বজাতীয় রাষ্ট্রক সমবায়েই প্রত্যেক জাতির প্রকৃত স্বার্থসাধন সম্ভব, কেননা পরস্পর নির্ভরতাই মানুষের ধর্ম, সেইদিনই রাষ্ট্রনীতিও বৃহৎভাবে মানুষের সত্যসাধনার ক্ষেত্র হবে । সেইদিনই সামাজিক মানুষ যে-সকল ধর্মনীতিকে সত্য বলে স্বীকার করে,