পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মিলে গোরাদের গায়ে যদি থুথু ফেলে তবে কামান বন্দুক -সমেত তাদের ভাসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই থুথু-ফেলাকে বলা যেতে পারে দুঃখগম্য তীর্থের সুখসাধ্য পথ । আধুনিক কালের বিজ্ঞানাভিমানী যুদ্ধপ্রণালীর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশের পক্ষে এমন নিখুঁত অথচ সরল উপায় আর নেই, এ কথা মানি । আর এও না-হয় আপাতত মেনে নেওয়া গেল যে, এই উপায়ে সরকারি খুতকার-প্লাবনে গোরাদের ভাসিয়ে দেওয়া অসম্ভব নয় ; তবু মানুষের চরিত্র যারা জানে তারা এটাও জানে যে, তেত্রিশ কোটি লোক একসঙ্গে থুথু ফেলবেই না । দেশের দৈন্য-সমুদ্র সেঁচে ফেলবার উদ্দেশে চরকা-চালনা সম্বন্ধেও ঐ কথা বলা চলে । আয়ার্লন্ডে সার হারেস প্ল্যাঙ্কেট যখন সমবায়জীবিকা-প্রবর্তনে প্ৰথম লেগেছিলেন তখন কত বাধা কত ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে গিয়েছিলেন, কত নূতন নূতন পরীক্ষা তাকে করতে হয়েছিল ; অবশেষে বহু চেষ্টার পরে সফলতার কিরকম শুরু হয়েছে। National Being বই পড়লে তা (दादों याद | अ9= ধরতে দেরি হয়, কিন্তু যখন ধরে তখন ছড়িয়ে যেতে বিলম্ব হয় না । শুধু তাই নয়, আসল সত্যের স্বরূপ এই যে, তাকে যে দেশের যে কোণেই পাওয়া ও প্রতিষ্ঠিত করা যায় সকল দেশেরই সমস্যা সে সমাধান করে । সার হারেস প্ল্যাঙ্কেট যখন আয়ার্লন্ডে সিদ্ধিলাভ করলেন তখন তিনি একই কালে ভারতবর্ষের জন্যেও সিদ্ধিকে আবাহন করে আনলেন । এমনি করেই কোনো সাধক ভারতবর্ষের একটিমাত্র পল্লীতেও দৈন্য দূর করবার মূলগত উপায় যদি চালাতে পারেন, তা হলে তিনি তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীকেই চিরকালের সম্পদ দিয়ে যাবেন । আয়তন পরিমাপ করে যারা সত্যের যথার্থ বিচার করে তারা সত্যকে বাহ্যিক ভাবে জড়ের সামিল করে দেখে ; তারা জানে না যে, অতি ছোটো বীজের মধ্যেও যে প্ৰাণটুকু থাকে সমস্ত পৃথিবীকে অধিকার করবার পরোয়ানা সে নিয়ে আসে । এইমাত্র আমার একজন বন্ধু বললেন যে, দেশের সাধারণ দৈন্যদুর বা স্বরাজলােভ বললে যতখানি বোঝায় তোমার মতে চরকায় সুতো কাটার লক্ষ ততদূর পর্যন্ত নাও যদি পৌঁছয়, তাতেই বা দোষ কী । চাষের কাজ যখন বন্ধ থাকে তখন চাষীর এবং গৃহকাজ প্রভৃতি সেরেও গৃহস্থর হাতে যে উপরি সময় বাকি থাকে, তাকে সকলে মিলে কোনো সৰ্ব্বজনসাধ্য লাভবান কাজে লাগালে সাধারণের অবস্থার অনেক উন্নতি হতে পারে, দেশে চরকা চলিত করার এই শুভ ফলাটুকুই ধরে নাও-না কেন । মনে আছে, এইজাতীয় আর-একটা কথা পূর্বে শুনেছিলাম। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোকেই ভাতের ফেন ফেলে দিয়ে থাকে । তার দ্বারা সমস্ত ভারত জুড়ে যে পুষ্টিকর খাদ্য নষ্ট হয়, তা সকলে মিলেই যদি রক্ষা করি তা হলে মোটের উপরে অনেকটা অন্নকষ্ট দূর হতে পারে । কথাটার মধ্যে সত্য আছে । ফেন-সমেত ভাত খেতে পেলে অভ্যস্ত রুচির কিছু বদল করা চাই, কিন্তু ফলের প্রতি লক্ষ করে দেখলে সেটা দুঃসাধ্য হওয়া উচিত নয় । এইরকম এমন আরো অনেক জিনিস আছে যাকে আমাদের দৈন্য লাঘব-উপায়ের তালিকার মধ্যে ধরা যেতে পারে । এ সম্বন্ধে র্যারা যেটা ভালো বোঝেন চালাতে চেষ্টা করুন-না, তার কোনোটাতে ধন বাড়বে, কোনোটাতে তার সঙ্গে পুষ্টিও বাড়বে, কোনোটাতে কিছু পরিমাণে আলস্যদেয কেটে যাবে। কিন্তু দেশে স্বরাজ-লাভের যে-একটা বিশেষ উদযোগ চলছে, দেশসুদ্ধ সকলে মিলে ভাতের ফেন না ফেলাকে তার একটা সর্বপ্রধান অঙ্গস্বরূপ করার কথা কারও তো মনেও হয় না । তার কি কোনো কারণ নেই । এ সম্বন্ধে আমার কথাটা পরিষ্কার করবার জন্যে ধর্মসাধনার দৃষ্টান্ত দিতে পারি। এই সাধন সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার উপলক্ষেই যদি বিশেষ জোর দিয়ে হাজারবার করে বলা হয় যে, যার-তার কুয়ো থেকে জল খেলে ধর্মভ্ৰষ্টতা ঘটে, তবে তার বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি এই যে, এমন উপদেশে ধর্মসাধনার নৈতিক পন্থার মূল্য কমিয়ে দেওয়া হয় । যার-তার কুয়োতে মলিনতা থাকার আশঙ্কা আছে, সেই মলিনতায় স্বাস্থ্য ক্লিষ্ট হয়, স্বাস্থ্যের বিকারে চিত্তের বিকার ঘটে, সেই বিকারে ধর্মহানি হওয়ার আশঙ্কা আছে- এ-সব কথাই সত্য বলে মানলেও তবু বলতেই হবে, অপ্রধানকে পরিমাণ-অতিরিক্ত মূল্য দিলে তাতে প্রধানের মূল্য কমে যায় । সেইজন্যেই আমাদের দেশে এমন অসংখ্য লোক আছে, মুসলমান যাদের কুয়ো থেকে জল তুলতে এলে মুসলমানকে মেরে খুন করতে যারা কুষ্ঠিত হয় না । ছোটোকে বড়োর সমান আসন দিলে সে সমান