পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর \სტ8(? থাকে না, সে বড়োকে ছাড়িয়ে যায়। এইজন্যেই জলের শুচিত-রক্ষার ধর্মবিধি মানুষের প্রাণীহিংসা না করার ধর্মবিধিকে অনায়াসে লঙঘন করতে পেরেছে । আমাদের দেশে নিত্যধর্মের সঙ্গে আচারধর্মকে মিলিয়ে দেওয়ার দ্বারা এরকম দুৰ্গতি যে কত ঘটছে, তা বলে শেষ করা যায় না । আমাদের এই মজাগত সনাতন অভ্যাসেরই জোরে আজ চরকা খন্দর সর্বপ্ৰধান স্বারাজিক ধর্মকর্মের বেশে গদা হাতে বেড়াতে পারল, কেউ তাতে বিশেষ বিস্মিত হল না । এই প্রাধান্যের দ্বারাতেই সে অনিষ্ট করছে, আমাদের দেশে বহুযুগসঞ্চারী দুর্বলতার আর-একটা নতুন খাদ্য জুগিয়ে দিচ্ছে। এর পরে আর-একদিন আর-কোনো বলশালী ব্যক্তি হয়তো স্বরাজ্য-সিংহাসন থেকে প্রচার করবেন যে, ভাতের ফেন যে ফেলে দেয় সেই অন্নঘাতীকে মন্ত্রণাসভায় ঢুকতে দেব না । তার যদি যথেষ্ট জোর থাকে এবং র্তার শাসন যদি বেশি দিন চলে তবে আমাদের দুর্ভাগ্য দেশে একদিন সাধুলোকে নিজেদের শুচিতারক্ষার জন্যে ভাতের ফেন-পাত উপলক্ষে মানুষের রক্তপাত করতে থাকবে । বিদেশী কাপড় পরায় অশুচিত ঘটে এই নিষেধ যদি দেশের অধিকাংশ লোকে গ্ৰহণ করে, এবং অন্ন জল প্রভৃতি সম্বন্ধীয় অশুচিতা বোধের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংস্কারগত হয়ে ওঠে, তা হলে সেদিন ঈদের দিনে কলকাতায় যেরকম মাথা-ফাটাফাটি হয়েছে। এ নিয়েও একদিন মেচ্ছ ও অস্নেচ্ছদের মধ্যে তেমনি সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব বেধে যাবে । যে আচার্যপরায়ণ সংস্কারের অন্ধতা থেকে আমাদের দেশে অস্পৃশ্যতারীতির উৎপত্তি সে অন্ধতাই আজ রাষ্ট্রিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়ে চরকা-খাদরিক অস্পৃশ্যতা-তত্ত্ব জাগিয়ে তুলছে। কেউ কেউ বলবেন, তুমি যে সমবায়জীবিকার কথা বলছি সকলে মিলে চরকা কাটাই তো তাই । আমি তা মানি না । সমস্ত হিন্দুসমাজে মিলে কুয়োর জলের শুচিত রক্ষা করলেও সেটা জীবাণুতত্ত্বমূলক স্বাস্থবিজ্ঞান হয়ে ওঠে না ; ওটা একটা কর্ম, ওটা একটা সত্য নয়। এইজনেই কুয়োর জল যখন শুচি থাকছে পুকুরের জল তখন মলিন হচ্ছে, ঘরের কানাচের কাছে গর্তায় ডোবায় তখন রোগের বীজাণু অপ্ৰতিহত প্রভাবে যমরাজের শাসন প্রচার করছে । আমাদের দেশে কাসুন্দি তৈরি করবার সময় আমরা অত্যন্ত সাবধান হই— এই সাবধানতার মূলে প্যাস্টার-আবিষ্কৃত তত্ত্ব আছে, কিন্তু যেহেতু তত্ত্বটা রোগের বীজাণুর মতোই অদৃশ্য আর বাহ্য কর্মটা পরিস্ফীত পিলেটারই মতো প্ৰকাণ্ড সেইজন্যেই এই কর্মপ্ৰণালীতে কেবলমাত্র কাসুন্দিই বাচছে, মানুষ বাচছে না । একমাত্র কাসুন্দি তৈরি কোটি লোকে মিলে বিশেষ আচার রক্ষা । তাতে সুতো অনেক জমবে, কিন্তু যুগে যুগে যে অন্ধত জমে উঠে আমাদের দারিদ্র্যাকে গড়বন্দী করে রেখেছে তার গায়ে হাত পড়বে না । মহাত্মাজির সঙ্গে কোনো বিষয়ে আমার মতের বা কার্যপ্ৰণালীর ভিন্নতা আমার পক্ষে অত্যন্ত অরুচিকর ৷ বড়ো করে দেখলে তাতে কোনো দোষ নেই । কিন্তু তবু সব সময়ে মন মানে না । কেননা, র্যাকে প্রীতি করি, ভক্তি করি, তার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার মতো আনন্দ আর কী হতে পারে । তার মহৎ চরিত্র আমার কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয় । ভারতের ভাগ্যবিধাতা তার হাত দিয়ে একটি দীপ্যমান দুৰ্জয় দিব্যশক্তি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন । এই শক্তি ভারতবাসীকে অভিভূত না করুক, বলশালী করুক ; তাকে নিজের মন দিয়ে চিন্তা করতে, সংকল্প করতে, ত্যাগ করতে শিক্ষা দিক- এই আমার কামনা । যে কারণ ভিতরে থাকতে রামমোহন রায়ের মতো অত বড়ো মনস্বীকেও মহাত্মা বামন বলতে কুষ্ঠিত হন নি- অথচ আমি সেই রামমোহনকে আধুনিক যুগের মহত্তম লোক বলেই জানি— সেই আভ্যন্তরিক মনঃপ্রকৃতিগত কারণেই মহাত্মাজির কর্মবিধিতে এমন রূপ ধারণ করেছে যাকে আমার স্বধর্ম। আপনি বলে গ্ৰহণ করতে পারছে না । সেজন্যে আমার খেদ রয়ে গেল । কিন্তু, সাধনার বিচিত্র পথই বিধাতার অভিপ্ৰেত, নইলে প্ৰকৃতিভেদ জগতে কেন থাকবে । ব্যক্তিগত অনুরাগের টানে মহাত্মাজির কাছ থেকে চরকায় দীক্ষা নেবার প্রবল ইচ্ছা বারে বারে আমার মনে এসেছে। কিন্তু, আমার বুদ্ধিবিচারে চরকার যতটুকু মর্যাদা তার চেয়ে পাছে বেশি স্বীকার করা হয়, এই ভয়ে অনেক দ্বিধা করে নিরস্ত হয়েছি। মহাত্মজি আমাকে ঠিক বুঝবেন জানি, এবং পূর্বেও বার বার