পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর V89. ঠেকছে, ঐখানেই যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলন হল না ; যদি মিলত তবে পাজিতে প্রতি বৎসরে যে ৩৬৫ দিন আছে সব কটা দিনই হত শুভদিন । এ কথা সত্য যে, পাজিতে দিন স্থির করে দিলে নেশা লাগে, তাই বলে নেশা লাগলেই যে পথ সহজ হয় তা বলতে পারি। নে । পাজির নির্দিষ্ট দিন অনেক কাল হল ভেসে চলে গেছে, কিন্তু নেশা ছোটে নি । সেই নেশার বিষয়টা এই যে, স্বরাজিয়া সাধন হচ্ছে সহজিয়া সাধন। একটি বা দুটি সংকীর্ণ পথই তার পথ । সেই পথের অন্তৰ্গত হয়ে পড়েছে চরকা । তা হলেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হয়, স্বরাজ জিনিসটা কী । আমাদের দেশনায়কেরা স্বরাজের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেন নি। স্বাধীনতা শব্দটার মানে বিস্তৃত । নিজের চরকায় নিজের সুতো কাটার স্বাধীনতা আমাদের আছে। কাটি নে তার কারণ কলের সুতোর সঙ্গে সাধারণত চরকার সুতো পাল্লা রাখতে পারে না । হয়তো পারে, যদি ভারতের বহু কোটি লোক আপনি বিনা মূল্যের অবসরকাল সুতো কাটায় নিযুক্ত করে চরকার সুতোর মূল্য কমিয়ে দেয় । এটা যে সম্ভবপর নয় তার প্রমাণ এই যে, বাংলাদেশে র্যারা চরকার পক্ষে লেখনী চালাচ্ছেন তারা অনেকেই চরকা চালাচ্ছেন না । দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, দেশে সকলে মিলে চরকা চালালে অর্থকষ্ট কিছু দূর হতে পারে । কিন্তু সেও স্বরাজ নয় । না হােক, সেটা অৰ্থ বটে তো । দারিদ্র্যের পক্ষে সেই বা কম কী । দেশের চাষীরা তাদের অবসরকাল বিনা উপার্জনে নষ্ট করে ; তারা যদি সবাই সুতো কাটে তা হলে তাদের দৈন্য অনেকটা দূর হয় । স্বীকার করে নেওয়া যাক, এও একটা বিশেষ সমস্যা বটে । চাষীদের উদ্যবৃত্ত সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে । কথাটা শুনতে যত সহজ তত সহজ নয় । এই সমস্যার সমাধানভার যদি নিতেই হয়, তবে এ সম্বন্ধে বুদ্ধির দুরূহ সাধনা দরকার । সংক্ষেপে বলে দিলেই হল না- ওরা চরকা কাটুক । চাষী চাষ করা কাজের নিয়ত অভ্যাসের দ্বারা আপনার মনকে ও দেহকে একটা বিশেষ প্রবণতা দিয়েছে । চাষের পথই তার সহজ পথ । যখন সে চাষ করে তখনই সে কাজ করে, যখন চাষ করে না তখন কাজ করে না । কুঁড়ে বলে কাজ করে না, এ অপবাদ তাকে দেওয়া অন্যায় । যদি সংবৎসর তার চাষ চলতে পারত, তা হলে বছর ভরেই সে কাজ করত । চাষ প্রভৃতি হাতের কাজের প্রকৃতিই এই যে, তাতে চালনার অভাবে মনকে নিশ্চেষ্ট করে দেয় । একটা চিরাভ্যস্ত কাজের থেকে আর-একটা ভিন্ন প্রকৃতির কাজে যেতে গেলেই মনের সক্রিয়তা চাই । কিন্তু চাষ প্ৰভৃতি মজুরির কােজ লাইন-বাধা কাজ । তা চলে ট্রামগাড়ির মতো । হাজার প্রয়োজন হলেও লাইনের বাইরে নতুন পথ তার পক্ষে সহজ নয় । চাষীকে চাষের বাইরে যে কাজ করতে বলা যায় তাতে তার মন ডিরেলডু হয়ে যায়। তবু ঠেলোঁঠুলে তাকে হয়তো নড়ানো যেতে পারে, কিন্তু তাতে শক্তির বিস্তর অপব্যয় ঘটে । বাংলাদেশের অন্তত দুই জেলার চাষীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় । অভ্যাসের বাধন তাদের পক্ষে যে কত কঠিন তার অভিজ্ঞতা আমার আছে। এক জেলা এক-ফসলের দেশ । সেখানে ধান উৎপন্ন করতে চাষীরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। তার পরে তাদের ভিটের জমিতে তারা অবসরকালে সবজি উৎপন্ন করতে পারত। উৎসাহ দিয়েছিলুম, ফল পাই নি । যারা ধান চাষের জন্য প্ৰাণপণ করতে পারে, তারা সবজি চাষের জন্য একটুও নড়ে বসতে চায় না । ধানের লাইন থেকে সবজির লাইনে তাদের মনকে ঠেলে তোলা কঠিন । আর-এক জেলায় চাষী ধান পাট আখি সর্ষে প্রভৃতি সকলরকম চাষেই লেগে আছে। কিন্তু যে জমিতে এ-সব শস্য সহজে হয় না সে জমি তাদের বৃথা পড়ে থাকে, তার খাজনা বহন করে চলে । অথচ বৎসরে বৎসরে পশ্চিম অঞ্চল থেকে চাষী এসে এই জমিতেই তরমুজ খরমুজ কঁকুড় প্রভৃতি ফলিয়ে যথেষ্ট লাভ করে নিয়ে দেশে ফিরে যায়। তবু স্থানীয় চাষী এই অনভ্যন্ত ফসল ফলিয়ে অবস্থার উন্নতি করতে বিমুখ । তাদের মন সরে না । যে চাষী পাটের ফলন করে তাকে স্বভাবত অলস বলে বদনাম দেওয়া চলে না। শুনেছি পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও কোথাও পাট উৎপন্ন করা কঠিন নয়,