পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ኃ8br রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু সেখানকার লোকেরা পাট প্রস্তুত করার দুঃসাধ্য দুঃখ বহন করতে নারাজ । বাংলাদেশে যে পাট একচেটি তার একমাত্র কারণ এখানকার জমিতে নয়, এখানকার চাষীতে । অথচ আমি দেখেছি, এই চাষীই তার বালুজমিতে তরমুজ ফলিয়ে লাভ করবার দৃষ্টান্ত বৎসর বৎসর স্বচক্ষে দেখাসত্ত্বেও এই অনভ্যস্ত পথে যেতে চায় না । যখন কোনো-একটা সমস্যার কথা ভাবতে হয় তখন মানুষের মনকে কী করে এক পথ থেকে আর-এক পথে চালানো যায় সেই শক্ত কথাটা ভাবতে হয়, কোনো-একটা সহজ উপায় বাহ্যিকভাবে বাতলিয়ে দিলেই যে কাজ হাসিল হয় তা বিশ্বাস করি নে— মানুষের মনের সঙ্গে রফানিস্পত্তি করাই হল গোড়ার কাজ । হিন্দু-মুসলমানের মিলন হােক, বাহিরের দিক থেকে এই পরোয়ানা জাহির করা কঠিন নয় । এই উপলক্ষে হিন্দুরা খিলাফৎ-আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, কেননা সেরকম যোগ দেওয়া খুবই সহজ । এমন-কি, নিজেদের আর্থিক সুবিধাও মুসলমানদের জন্য অনেক পরিমাণে ত্যাগ করতে পারে ; সেটা দুরূহ সন্দেহ নেই, তবু “এহ বাহ্য।” । কিন্তু, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের উদ্দেশে পরস্পরের মনের চিরাগত সংস্কারের পরিবর্তন করা সহজ নয় । সমস্যাটা সেইখানেই ঠেকেছে। হিন্দুর কাছে মুসলমান অশুচি, আর মুসলমানের কাছে হিন্দু কাফের- স্বরাজপ্ৰাপ্তির লোভেও এ কথাটা ভিতর থেকে উভয় পক্ষের কেউ তুলতে পারে না । আমি একজন ইংরেজিনবিশের কথা জানতেম, হােটেলের খানার প্রতি তার খুব লোভ ছিল । তিনি আর-সমস্তই রুচিপূর্বক আহার করতেন, কেবল গ্রেট-ইস্টারনের ভাতটা বাদ দিতেন ; বলতেন, মুসলমানের রান্না ভাতটা কিছুতেই মুখে উঠতে চায় না । যে সংস্কারগত কারণে ভাত খেতে বাধে সেই সংস্কারগত কারণেই মুসলমানের সঙ্গে ভালো করে মিলতে তার বাধবে । ধর্মনিয়মের আদেশ নিয়ে মনের যে-সকল অভ্যাস আমাদের অন্তনিহিত সেই অভ্যাসের মধ্যেই হিন্দু-মুসলমান-বিরোধের দৃঢ়তা আপন সনাতন কেল্লা বেঁধে আছে ; খিলাফতের আনুকুল্য বা আর্থিক ত্যাগাস্বীকার সেই অন্দরে গিয়ে পৌঁছয় না । আমাদের দেশের এই-সকল সমস্যা আন্তরিক বলেই এত দুরূহ। বাধা আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই আছে ; সেটা দূর করবার কথা বললে আমাদের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । এই কারণে একটা অত্যন্ত সহজ বাহ্যিক প্ৰণালীর কথা শুনলেই আমরা হাফ ছেড়ে বাচি । ঠিক পথে অর্থ-উপার্জনের বাধা যার অন্তরের মধ্যে আছে সেই ব্যক্তিই জুয়ো খেলে রাতারাতি বড়োমানুষ হবার দুরাশায় নিজের সর্বনাশ করতেও প্ৰস্তুত হয় । চরকা কাটা স্বরাজ-সাধনার প্রধান অঙ্গ এ কথা যদি সাধারণে স্বীকার করে তবে মানতেই হয়, সাধারণের মতে স্বরাজটা একটা বাহ্য ফললাভ । এইজন্যই দেশের মঙ্গলসাধনে আত্মপ্ৰভাবের যে-সকল চরিত্রগত ও সামাজিক প্রথাগত বাধা আছে সেই প্ৰধান বিষয় থেকে আমাদের মনকে সরিয়ে এনে চরকা-চালনার উপরে তাকে অত্যন্ত নিবিষ্ট করলে লোকে বিস্মিত হয় না, বরঞ্চ আরাম পায় । এমন অবস্থায় ধরেই নেওয়া যাক যে, চাষীরা তাদের অবসরকাল যদি লাভবান কাজে লাগায় তা হলে আমাদের স্বরাজ-লাভের একটা প্রধান অন্তরায় দূর হতে পারে ; ধরেই নেওয়া যাক, এই বাহ্যিক ব্যাপারটাই আমাদের দেশে সব চেয়ে আজ পরম চিন্তনীয় । তা হলে দেশনায়কদের ভাবতে হবে, চাষীদের অবকাশকালকে সম্যকরূপে কী উপায়ে খাটানো যেতে পারে । বলা বাহুল্য, চাষের কাজে খাটাতে পারলেই ঠিক রাস্তাটা পাওয়া যায় । আমার যদি কঠিন দৈন্যসংকট ঘটে। তবে আমার পরামর্শদাতা হিতৈষীকে এই কথাই সর্বাগ্ৰে চিন্তা করতে হবে যে, আমি দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্যরচনাতেই অভ্যন্ত । বাগব্যবসায়ের প্রতি তার যতই অশ্রদ্ধা থাক, আমার উপকার করতে চাইলে এ কথা তিনি উড়িয়ে দিতে পারবেন না । তিনি হয়তো হিসাব খতিয়ে আমাকে স্পষ্ট দেখিয়ে দিতে পারেন যে, ছাত্রদের জন্যে কলেজ-পড়ায় যদি চায়ের দোকান খুলি তা হলে শতকরা ৭৫ টাকা হারে মুনাফা হতে পারে। হিসাব থেকে মানুষের মনটাকে বাদ দিলে লাভের অঙ্কটাকে খুব বড়ো করে দেখানো সহজ । চায়ের দোকান করতে গিয়ে আমি যে নিজেকে সর্বস্বান্ত করতে পারি তার কারণ এ নয় যে, সুযোগ্য চা-ওয়ালার মতো আমার বুদ্ধি নেই, তার কারণ