পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VeG NR রবীন্দ্র-রচনাবলী র্যাদের আমরা ভদ্রলোক বলে থাকি তঁরা স্থির করেছিলেন যে, রাজপুরুষে ও ভদ্রলোকে মিলে ভারতের রাজগদি ভাগাভাগি করে নেওয়াই পলিটিকস। সেই পলিটিকসে যুদ্ধবিগ্ৰহ সন্ধিশান্তি উভয় ব্যাপারই বক্তৃতামঞ্চে ও খবরের কাগজে, তার অস্ত্ৰ বিশুদ্ধ ইংরাজি ভাষা—কখনো অনুনয়ের করুণ কাকলি, কখনো-বা কৃত্রিম কোপের উত্তপ্ত উদ্দীপনা । আর দেশে যখন এই প্ৰগলভ বাগবাত্যা বায়ুমণ্ডলের উর্ধর্বস্তরে বিচিত্র বাস্পলীলা-রচনায় নিযুক্ত তখন দেশের যারা মাটির মানুষ তারা সনাতন নিয়মে জন্মাচ্ছে মরছে, চাষ করছে, কাপড় বুনছে, নিজের রক্তে মাংসে সর্বপ্রকার শ্বাপদ-মানুষের আহার জোগাচ্ছে, যে দেবতা তাদের ছোয়া লাগলে অশুচি হন মন্দির-প্রাঙ্গণের বাইরে সেই দেবতাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্ৰণাম করছে, মাতৃভাষায় কাদছে হাসছে, আর মাথার উপর অপমানের মুষলধারা নিয়ে কপালে করাঘাত করে বলছে “অদৃষ্ট । দেশের সেই পোলিটিশান আর দেশের সর্বসাধারণ, উভয়ের মধ্যে অসীম দূরত্ব । সেই পলিটিকস আজ মুখ ফিরিয়েছে, অভিমানিনী যেমন করে বল্লাভের কাছ থেকে মুখ ফেরায় । বলছে, কালো মেঘ। আর হেরব না গো দূতী ৷ তখন ছিল পূর্বরাগ ও অভিসার, এখন চলছে মান এবং বিচ্ছেদ । পালা বদল হয়েছে, কিন্তু লীলা বদল হয় নি । কাল যেমন জোরে বলেছিলেম “চাই, আজ তেমনি জোরেই বলছি “চাই নে” । সেইসঙ্গে এই কথা যোগ করেছি বটে যে, পল্লীবাসী জনসাধারণের অবস্থার উন্নতি করাতে চাই । অর্থাৎ, এরাই আমার আপনি, ওরা আমার পর । কিন্তু 'চাই নে “চাই নে? বলবার হুহুংকারেই গলার জোর গায়ের জোর চুকিয়ে দিই । তার সঙ্গে যেটুকু “চাই’ জুড়ি তার আওয়াজ বড়ো মিহি । যে আছিলাতেই অর্থ কিছু সংগ্ৰহ করি ভদ্রসমাজের পোলিটিকাল বারোয়ারি জমিয়ে তুলতেই তা ফুরিয়ে যায়, তার পরে অর্থ গেলে শব্দ যেটুকু বাকি থাকে সেটুকু থাকে। পল্লীর হিতের জন্যে । অর্থাৎ, আমাদের আধুনিক পলিটিকসের শুরু থেকেই আমরা নিৰ্গুণ দেশপ্রেমের চর্চা করেছি। দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে । এই নিরুপাধিক প্ৰেমচৰ্চার অর্থ যারা জোগান তাদের কারও বা আছে জমিদারি, কারও বা আছে কারখানা ; আর শব্দ যারা জোগান তারা আইনব্যবসায়ী । এর মধ্যে পল্লীবাসী কোনো জায়গাতেই নেই ; অর্থাৎ আমরা যাকে দেশ বলি সেই প্ৰতাপাদিত্যের প্রেতলোকে তারা থাকে না । তারা অত্যন্ত প্ৰতাপহীন-কি শব্দসম্বলে কি অর্থসম্বলে । যদি দেওয়ানি অবাধ্যতা চলত তা হলে তাদের ডাকতে হত বটে, সে কেবল খাজনা বন্ধ করে মরবার জন্যে । আর, যাদের অদ্য-ভক্ষ্য-ধনুৰ্গুণ তাদের এখনো মাঝে মাঝে ডাক পাড়া হয় দোকান বন্ধ করে হরতাল করবার জন্যে, উপরওয়ালাদের কাছে আমাদের পোলিটিকাল বঁাকা ভঙ্গিটাকে অত্যন্ত তেড়া করে দেখাবার উদ্দেশ্যে । এই কারণেই রায়তের কথাটা মুলতুবিই থেকে যায় । আগে পাতা হােক সিংহাসন, গড়া হোক মুকুট, খাড়া হােক রাজদণ্ড, ম্যাঞ্চেস্টার পরুবক কোপনি-- তার পর সময় পাওয়া যাবে রায়তের কথা পাড়বার । অর্থাৎ, দেশের পলিটিকস আগে, দেশের মানুষ পরে । তাই শুরুতেই পলিটিকসের সাজ-ফরমাশের ধুম পড়ে গেছে । সুবিধা এই যে, মাপ নেবার জন্যে কোনো সজীব মানুষের দরকার নেই। অন্য দেশের মানুষ নিজের দেহের বহর ও আবহাওয়ার প্রতি দৃষ্টি রেখে বার বার কেটে-ছেটে বদলে জুড়ে যে সাজ বানিয়েছে ঠিক সেই নমুনাটা দর্জির দোকানে চালান করলেই হবে । সাজের নামও জানি- একেবারে কেতাবের পাতা থেকে সদ্য-মুখস্থ— কেননা, আমাদের কারখানাঘরে নাম আগে, রূপ পরে । ডিমোক্রেসি, পার্লেমেন্ট, কানাডা অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ-আফ্রিকার রাষ্ট্রতন্ত্র ইত্যাদি, এর সমস্তই আমরা চোখ বুজে কল্পনা করতে পারি ; কেননা গায়ের মাপ নেবার জন্যে মানুষকে সামনে রাখবার বালাই একেবারেই নেই। এই সুবিধাটুকু নিষ্কণ্টকে ভোগ করবার জন্যেই বলে থাকি, আগে স্বরাজ, তার পরে স্বরাজ যাদের জন্যে তারা । পৃথিবীতে অন্য সব জায়গাতেই দেশের মানুষ নিজের প্রকৃতি শক্তি ও প্রয়োজনের স্বাভাবিক প্রবর্তনায় আপনিই আপনার স্বরাজ গড়ে তুলেছে ; জগতে আমরাই কেবল পঞ্জিকার কোনো-একটি আসন্ন পয়লা জানুয়ারিতে আগে স্বরাজ পাব, তার পরে স্বরাজ্যের লোক ডেকে যেমন করে হােক সেটাকে তাদের গায়ে চাপিয়ে দেব । ইতিমধ্যে ম্যালেরিয়া