পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর ○○ ○ গলায়-ফাস-লাগানো মেয়ের বিয়ে, মায়ের শ্রাদ্ধ, সহস্ৰবাহু সমাজের ট্যাকসো আর আছে ওকালতির দংষ্ট্রােকরাল সর্বস্বলোলুপ আদালত । এই-সব কারণে আমাদের পলিটিকসে তোমার ‘রায়তের কথা’ স্থানকালপাত্ৰোচিত হয়েছে কি না। সন্দেহ করি । তুমি ঘোড়ার সামনের দিকে গাড়ি জোতবার আয়োজনে যোগ দিচ্ছ না ; শুধু তাই নয়, ঘোড়াটাকে জোতবার উদযোগ বন্ধ রেখে খবর নিতে চাও সে দানা পেলে কি না, ওর দম কতটুকু বাকি । তোমার মন্ত্রণাদাতা বন্ধুদের মধ্যে এমন কী কেউ নেই যে তোমাকে বলতে পারে- আগে গাড়ি টানাও, তা হলেই অমুক শুভ লগ্নে গম্যস্থানে পৌঁছবই ; তার পরে পৌঁছবা মাত্রই যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে খবর নেবার জন্যে যে ঘোড়াটা সচল না। আচল, বেঁচে আছে না মরেছে । তোমার জানা উচিত ছিল, হাল আমলের পলিটিকসে টাইমটেবিল তৈরি, তোরঙ্গ গুছিয়ে গাড়িতে চড়ে বসাই প্ৰধান কর্তব্য । অবশেষে গাড়িটা কোনো জায়গাতেই পৌঁছয় না বটে, কিন্তু সেটা টাইমটেবলের দোষ নয় ; ঘোড়াটা চললেই হিসেব ঠিক মিলে যেত। তুমি তার্কিক ; এত বড়ো উৎসাহে বাধা দিয়ে বলতে চাও, ঘোড়াটা যে চলে না বহুকাল থেকে সেইটেই গােড়াকার সমস্যা । তুমি সাবেক ফ্যাশানের সাবধানী মানুষ, আস্তাবলের খবরটা আগে চাও । এ দিকে হাল ফ্যাশানের উৎসাহী মানুষ কোচুবাক্সে চড়ে বসে অস্থিরভাবে পা ঘষছে ; ঘরে আগুন লাগার উপমা দিয়ে সে বলেছে, অতি শীঘ্ৰ পৌঁছনো চাই, এইটেই একমাত্র জরুরি কথা । অতএব ঘোড়ার খবর নেওয়া নিছক সময় নষ্ট করা । সব আগে দরকার গাডিতে চড়ে বসা । তোমার ‘রায়তের কথা” সেই ঘোড়ার কথা, যাকে বলা যেতে পারে গোড়ার কথা । কিন্তু ভাবনার কথা এই যে, বর্তমান কালে একদল জোয়ান মানুষ রায়তের দিকে মন দিতে শুরু করেছেন । সব আগে তার হাতের গুলি পাকাচ্ছেন । বোঝা যাচ্ছে, তারা বিদেশে কোথাও একটা নজির পেয়েছেন । আমাদের মন যখন অত্যন্ত আড়ম্বরে স্বদেশিক হয়ে ওঠে তখনো দেখা যায়, সেই আড়ম্বরের সমস্ত মালমসলার গায়ে ছাপ মারা আছে ‘Made in Europe.” । যুরোপে প্রকৃতিগত ও অবস্থাগত কারণের স্বাভাবিক বেগে মানুষ সোশ্যালিজম, কমু্যনিজম, সিন্ডিক্যালিজম প্রভৃতি নানাপ্রকার সামাজিক পরিবর্তনের পরখ করছে । কিন্তু আমরা যখন বলি, রায়তের ভালো করব, তখন যুরোপের বাধি বুলি ছাড়া আমাদের মুখে বুলি বেরোয় না । এবার পূর্ববঙ্গে গিয়ে দেখে এলুম, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুশাকুরের মতো ক্ষণভঙ্গুর সাহিত্য গজিয়ে উঠছে । তারা সব ছোটাে ছোটাে এক-একটি রক্তপাতের ধবজা । বলছে, পিষে ফেলো, দলে ফেলো ; অর্থাৎ ধারণী নির্জমিদার নির্মহাজন হোক । যেন জবরদস্তির দ্বারা পাপ যায়, যেন অন্ধকারকে লাঠি মারলে সে মরে । এ কেমন, যেন বৌয়ের দল বলছে, শাশুড়িগুলোকে গুণ্ডা লাগিয়ে গঙ্গাযাত্রা করাও, তা হলেই বধূরা নিরাপদ হবে । ভুলে যায় যে, মরা শাশুড়ির ভূত ঘাড়ে চেপে তাদের শাশুড়িতর শাশুড়িতম করে তুলতে দেরি করে না । আমাদের দেশের শাস্ত্রে বলে, বাইরের থেকে আত্মহত্যা করে ম’লেই ভববন্ধন ছেদন করা যায় না- স্বভাবের ভিতর থেকে বন্ধনের মূলাচ্ছেদ করতে হয় । যুরোপের স্বভাবটা মারমুখে । পাপকে ভিতর থেকে মারতে সময় লাগে- তাদের সে তার সয় না, তারা বাইরে থেকে মানুষকে মারে । পুতুলখেলা খেলতে বসেছিলেম । তার কারণ, সেদিন পলিটিকসের আদর্শটাই য়ুরোপের অন্য সব-কিছুর চেয়ে আমাদের কাছে প্রত্যক্ষগোচর ছিল । তখন য়ুরোপীয় যে সাহিত্য আমাদের মন দখল করেছে তার মধ্যে মািটসিনি গারিবােলডির সুরাটাই ছিল প্ৰধান । এখন সেখানে নাট্যের পালা বদল হয়েছে । লঙ্কাকাণ্ডে ছিল রাজবীরের জয়, ছিল