পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VG 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী দানবের হাত থেকে সীতার মুক্তির কথা । উত্তরকাণ্ডে আছে দুমুখের জয়, রাজার মাথা হেঁট, প্রজার মন জোগাবার তাগিদে রাজরানীকে বিসর্জন । যুদ্ধের দিনে ছিল রাজার মহিমা, এখন এল প্ৰজার মহিমা । তখন গান চলছিল, বাহিরের বিরুদ্ধে ঘরের জয় ; এখনকার গান, ইমারতের বিরুদ্ধে আঙিনার জয় । ইদানীং পশ্চিমে বলশেভিজম ফ্যাসিজম প্রভৃতি যে-সব উদযোগ দেখা দিয়েছে আমরা যে তার কার্যকারণ তার আকার-প্রকার সুস্পষ্ট বুঝি তা নয় ; কেবল মোটের উপর বুঝেছি যে গুণ্ডাতন্ত্রের আখড়া জমল । আমনি আমাদের নকল নিপুণ মন গুণ্ডামিটাকেই সব চেয়ে বড়ো করে দেখতে বসেছে। বরাহ-অবতার পঙ্কনিমগ্ন ধরাতলকে দাতের ঠেলায় উপরে তুলেছিলেন, এরা তুলতে চায় লাঠির ঠেলায় । এ কথা ভাববার অবকাশও নেই সাহসও নেই যে, গোয়াতুমির দ্বারা উপর ও নীচের অসামঞ্জস্য ঘোচে না । অসামঞ্জস্যের কারণ মানুষের চিত্তবৃত্তির মধ্যে ! সেইজন্যেই আজকের দিনের নীচের থাকটাকে উপরে তুলে দিলে, কালকের দিনের উপরের থাকাটা নীচের দিকে পূর্বের মতোই চাপ লাগবে । রাশিয়ার জার-তন্ত্র ও বলশেভিক তন্ত্র একই দানবের পাশমোড়া দেওয়া । পূর্বে যে ফোড়াটা বা হাতে ছিল আজ সেটাকে ডান হাতে চালান করে দিয়ে যদি তাণ্ডবনৃত্য করা যায়, তা হলে সেটাকে বলতেই হবে পাগলামি । যাদের রক্তের তেজ বেশি, এক-এক সময়ে মাথায় বিপরীত রক্ত চড়ে গিয়ে তাদের পাগলামি দেখা দেয়- কিন্তু সেই দেখাদেখি নকল পাগলামি চেপে বসে অন্য লোকের, যাদের রক্তের জোর কম ; তাকেই বলে হিসটিরিয়া । আজ তাই যখন শুনে এলুম সাহিত্যে ইশারা চলছে, মহাজনকে লােগাও বাড়ি, জমিদারকে ফেলো পিষে, তখনই বুঝতে পারলুম, এই লালমুখে বুলির উৎপত্তি এদের নিজের রক্তের থেকে নয় । এ হচ্ছে বাঙালির অসাধারণ নকলনৈপুণ্যের নাট্য, ম্যাজেন্ট রঙে ছোবানো । এর আছে উপরে হাত পা ছোড়া, ভিতরে চিত্তহীনতা । \9 আমি নিজে জমিদার, এইজন্য হঠাৎ মনে হতে পারে, আমি বুঝি নিজের আসন বঁাচাতে চাই । যদি চাই তা হলে দোষ দেওয়া যায় না- ওটা মানবস্বভাব । যারা সেই অধিকার কাড়তে চায় তাদের যে বুদ্ধি, যারা সেই অধিকার রাখতে চায় তাদেরও সেই বুদ্ধি ; অর্থাৎ কোনোটাই ঠিক ধর্মবুদ্ধি নয়, ওকে বিষয়বুদ্ধি বলা যেতে পারে। আজ যারা কাড়তে চায় যদি তাদের চেষ্টা সফল হয় তবে কাল তারাই বনবিড়াল হয়ে উঠবে । হয়তো শিকারের বিষয়-পরিবর্তন হবে, কিন্তু দাত-নখের ব্যবহারটা কিছুমাত্র বৈষ্ণব ধরনের হবে না । আজ অধিকার কাড়বার বেলা তারা যে-সব উচ্চ-অঙ্গের কথা বলে তাতে বোঝা যায় তাদের ‘নামে রুচি আছে, কিন্তু কাল যখন “জীবে দয়া’র দিন আসবে তখন দেখব আমিষের প্রতি জিহবার লেলিহান চাঞ্চল্য । কারণ, নামটা হচ্ছে মুখে আর লোভটা হচ্ছে মনে । অতএব, দেশের চিত্তবৃত্তির মাটিতে আজ যে জমিদার দেখা দিয়েছে সে যদি নিছক কাটগাছই হয়, তা হলে তাকে দ’লে ফেললেও সেই মরা গাছের সারে দ্বিতীয় দফা কঁাটাগাছের শ্ৰীবৃদ্ধিই ঘটবে । কারণ, शांदिष्ठ्ल शब्न क्षी (ऊ । আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি । এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিসটার পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব । আমি জানি জমিদার জমির জোক ; সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব । আমরা পরিশ্রম না করে, উপার্জন না করে, কোনো যথার্থ দায়িত্ব গ্ৰহণ না করে ঐশ্বর্যভোগের দ্বারা দেহকে অপটু ও চিত্তকে অলস করে তুলি । যারা বীর্যের দ্বারা বিলাসের অধিকার লাভ করে আমরা সে জাতির মানুষ নই। প্রজারা আমাদের অন্ন জোগায় আর আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়— এর মধ্যে পৌরুষও নেই, গৌরবও নেই । নিজেকে ছোটো হাতের মাপে রাজা বলে কল্পনা করবার একটা অভিমান আছে বটে । ‘রায়তের কথায় পুরাতন দপ্তর ঘেঁটে তুমি সেই সুখস্বপ্নেও বাদ সাধতে বসেছি । তুমি প্রমাণ করতে চাও যে, আমরা ইংরেজ- রাজসরকারের পুরুষানুক্রমিক গোমস্তা । আমরা এদিকে রাজার নিমক খাচ্ছি- রায়তদের বলছি "প্রজা’, তারা আমাদের বলছে ‘রাজা’- মস্ত একটা ফকির