পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর や○ (? حالي মধ্যে আছি । এমন জমিদারি ছেড়ে দিলেই তো হয । কিন্তু, কাকে ছেড়ে দেব । অন্য এক জমিদারকে ? গোলাম-চোর খেলার গোলাম যাকেই গতিয়ে দিই, তার দ্বারা গোলাম-চোরকে ঠেকানো হয় না । প্ৰজাকে ছেড়ে দেব ? তখন দেখতে দেখতে এক বড়ো জমিদারের জায়গায় দশ ছোটো জমিদার গজিয়ে উঠবে । রক্তপিপাসায় বড়ো জোকের চেয়ে ছিনে জোকের প্রবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে তা বলতে পারি। নে ! তুমি বলেছ, জমি চাষ করে যে জমি তারই হওয়া উচিত । কেমন করে তা হবে । জমি যদি পণ্যদ্রব্য হয়, যদি তার হস্তাস্তরে বাধা না থাকে ? এ কথা মোটের উপর বলা চলে যে, বই তারই হওয়া উচিত যে মানুষ বই পড়ে । যে মানুষ পড়ে না। অথচ সাজিয়ে রেখে দেয়, বইয়ের সদব্যবহারীকে সে বঞ্চিত করে । কিন্তু, বই যদি পটলডাঙার দোকানে বিক্রি করতে কোনো বাধা না থাকে তা হলে যার বইয়ের শেলফা আছে, বুদ্ধি বিদ্যা নেই, সে যে বই কিনবে না। এমন ব্যবস্থা কী করে করা যায় । সংসারে বইয়ের শেলফ বুদ্ধির চেয়ে অনেক সুলভ ও প্রচুর । এই কারণে অধিকাংশ বইয়ের গতি হয় শেলফের থাকে, বুদ্ধিমানের ডেস্কে নয় । সরস্বতীর বরপুত্র যে ছবি রচনা করে লক্ষ্মীর বরপুত্র তাকে দখল করে বসে। অধিকার আছে বলে নয়, ব্যাঙ্কে টাকা আছে বলে । যাদের মেজাজ কড়া, সম্বল কম, এ অবস্থায় তারা খাপ্পা হয়ে ওঠে । বলে, মারো টাকাওয়ালাকে, কাড়ো ছবি । কিন্তু, চিত্রকারের পেটের দায় যতদিন আছে, ছবি যতদিন বাজারে আসতে বাধ্য, ততদিন লক্ষ্মীমানের ঘরের দিকে ছবির টান কেউ ঠেকাতে পারবে না । 8 জমি যদি খোলা বাজারে বিক্রি হয়ই তা হলে যে ব্যক্তি স্বয়ং চাষ করে তার কেনবার সম্ভাবনা অল্পই ; যে লোক চাষ করে না। কিন্তু যার আছে টাকা, অধিকাংশ বিক্রয়যোগ্য জমি তার হাতে পড়বেই। জমির বিক্রয়ের সংখ্যা কালে কালে ক্রমেই যে বেড়ে যাবে, এ কথাও সত্য । কারণ, উত্তরাধিকারসূত্রে জমি যতই খণ্ড খণ্ড হতে থাকবে, চাষীর সাংসারিক অভাবের পক্ষে সে জমি ততই অল্প-স্বত্ব হবেই ; কাজেই অভাবের তাড়ায় খরিদ-বিক্রি বেড়ে চলবে । এমনি করে ছোটো ছোটো জমিগুলি স্থানীয় মহাজনের বড়ো বড়ো বেড়াজালের মধ্যে বঁাকে বঁাকে ধরা পড়ে । তার ফলে জাতার দুই পাথরের মাঝখানে গোটা রায়ত আর বাকি থাকে না । এক জমিদারের আমলে জমিতে রায়তের যেটুকু অধিকার, জমিদার-মহাজনের দ্বন্দ্ব-সমাসে তা আর টেকে না । আমার অনেক রায়তকে এই চরম অকিঞ্চনত থেকে আমি নিজে রক্ষা করেছি। জমিহস্তান্তরের বাধার উপর জোর দিয়ে । মহাজনকে বঞ্চিত করি নি, কিন্তু তাকে রফা করতে বাধা করেছি । যাদের সম্বন্ধে তা করা একেবারে অসম্ভব হয়েছে, তাদের কান্না আমার দরবার থেকে বিধাতার দরবারে গেছে । পরলোকে তারা কোনো খেসারত পাবে কি না সে তত্ত্ব এই প্রবন্ধে আলোচ্য নয় । নীলচাষের আমলে নীলকর যখন ঋণের ফাসে ফেলে প্ৰজার জমি আত্মসাৎ করবার চেষ্টায় ছিল তখন জমিদার রায়তকে বাচিয়েছে। নিষেধ-আইনের বাধ যদি সেদিন না থাকত তা হলে নীলের বন্যায় রায়তি জমি ডুবে একাকার হত । মনে করো, আজ কোনো কারণে বাংলার উৎপন্ন ফসলের প্ৰতি যদি মাড়োয়ারি দখল-স্থাপনের উদ্দেশে ক্রমশ প্রজার জমি ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছা করে, তা হলে অতি সহজেই সমস্ত বাংলা তারা ঘানির পাকে ঘুরিয়ে তার সমস্ত তেল নিঙড়ে নিতে পারে । এমন মতলব এদের কারও মাথায় যে কোনোদিন আসে নি, তা মনে করবার হেতু নেই । যে-সব ব্যবসায়ে এরা আজ নিযুক্ত আছে তার মুনফায় বিঘ্ন ঘটলেই আবদ্ধ মূলধন এই সব খাতের সন্ধান খুঁজবেই । এখন কথা হচ্ছে, ঘরের দিকে বেনো জল ঢোকাবার অনুকুল খালখনন কি রায়তের পক্ষে ভালো । মূল কথাটা এই-- রায়তের বুদ্ধি নেই, বিদ্যা নেই, শক্তি নেই, আর ধনস্থানে শনি । তারা কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করতে জানে না । তাদের মধ্যে যারা জানে তাদের মতো ভয়ংকর জীব আর নেই । রায়ত-খাদক রায়তের ক্ষুধা যে কত সর্বনেশে তার পরিচয় আমার জানা আছে। তারা যে প্ৰণালীর