পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর N2 ( Գ কিন্তু এ-সব গেল খুচরো কথা । আসল কথা, যে মানুষ নিজেকে বাচাতে জানে না কোনো আইন তাকে বাচাতে পারে না । নিজেকে এই-যে বঁাচাবার শক্তি তা জীবনযাত্রার সমগ্রতার মধ্যে, কোনো-একটা খাপছাড়া প্ৰণালীতে নয় । তা বিশেষ আইনে নয়, চরকায় নয়, খন্দরে নয়, কনগ্রেসে ভোট দেবার চার-আনা ক্রীত অধিকারে নয় । পল্লীর মধ্যে সমগ্রভাবে প্রাণসঞ্চার হলে তবেই সেই প্ৰাণের সম্পূর্ণতা নিজেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করবার শক্তি নিজের ভিতর থেকেই উদ্ভাবন করতে পারবে । কেমন করে সেটা হবে সেই তত্ত্বটাই কাজে ও কথায় কিছুকাল থেকে ভাবছি। ভালো জবাব দিয়ে যেতে পারব কি না জানি নে- জবাব তৈরি হয়ে উঠতে সময় লাগে । তবু আমি পারি বা না পারি, এই মোটা জবাবটাই খুঁজে বের করতে হবে । সমস্ত খুচরো প্রশ্নের সমাধান এরই মধ্যে ! নইলে তালি দিতে দিতে দিন বয়ে যাবে ; যার জন্যে এত জোড়াতাড়া সে ততকাল পর্যন্ত টিকবে কি না সন্দেহ । আষাঢ় ১৩৩৩ স্বামী শ্রদ্ধানন্দ আমাদের দেশে র্যারা সত্যের ব্ৰত গ্ৰহণ করবার অধিকারী এবং সেই ব্ৰতকে প্ৰাণ দিয়ে র্যারা পালন করবার শক্তি রাখেন তাদের সংখ্যা অল্প বলেই দেশের এত দুৰ্গতি । এমন চিত্তদৈন্য যেখানে, সেখানে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের মতো অতো বড়ো বীরের এমন মৃত্যু যে কতদূর শোকাবহ তার বর্ণনায় প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে একটি কথা এই আছে যে, তার মৃত্যু যতই শোচনীয় হােক, সে মৃত্যুতে তার প্রাণ তার চরিত্র ততই মহীয়ান হয়েছে । বারে বারে ইতিহাসে দেখা যায়, নিজের সমস্ত দিয়ে র্যারা কল্যাণব্ৰতকে গ্রহণ করেছেন অপমান ও অপমৃত্যু তাদের ললাটে জয়তিলক এমনি করেই ঐকেছে । মহাপুরুষরা আসেন প্ৰাণকে মৃত্যুর উপরেও জয়ী করতে, সত্যকে জীবনের সামগ্ৰী করে তুলতে । আমাদের খাদ্যদ্রব্যে প্ৰাণ দেবার যা উপকরণ রয়েছে তা বায়ুতে আছে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারেও আছে । কিন্তু, যতক্ষণ তা উদ্ভিদে প্ৰাণীতে জৈব আকার না। ধারণ করে ততক্ষণ প্ৰাণের পুষ্টি হয় না । সত্য সম্বন্ধেও সে কথা খাটে । শুধুমাত্ৰ বাক্যের হাওয়া থেকে আকর্ষণ করে নিয়ে তাকে জীবনগত করবার শক্তি ক'জনােরই বা আছে । সত্যকে জানে অনেক লোকে, তাকে মানে সেই মানুষ যে বিশেষ শক্তিমান ; প্ৰাণ দিয়ে তাকে মানার দ্বারাই সত্যকে আমরা সকল মানুষের করে দিই। এই মানতে পারার শক্তিটাই মস্ত জিনিস । এই শক্তির সম্পদ র্যারা সমাজকে দেন তাদের দান মহামূল্য ; সত্যের প্ৰতি সেই নিষ্ঠার আদর্শ শ্রদ্ধানন্দ এই দুর্বল দেশকে দিয়ে গেছেন । তার সাধনা-পরিচয়ের উপযোগী যে নাম তিনি গ্ৰহণ করেছিলেন সেই নাম তার সার্থক । সত্যকে তিনি শ্রদ্ধা করেছেন । এই শ্রদ্ধার মধ্যে সৃষ্টিশক্তি আছে। সেই শক্তির দ্বারা তার সাধনাকে রূপমূর্তি দিয়ে তাকে তিনি সজীব করে গেছেন । তাই তার মৃত্যুও আলোকের মতো হয়ে উঠে তার শ্রদ্ধার সেই ভয়হীন ক্ষয়হীন ক্লান্তিহীন অমৃতচ্ছবিকে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করেছে। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধার এই ভূমানন্দকে তার চরিত্রের মধ্যে আজ আমরা যেন সার্থক আকারে দেখতে পারি। এই সার্থকতা বাহ্য ফলে নয়, নিজেরই অকৃত্রিম বাস্তবতায় । অপঘাতের এই যে আঘাত শুধু মহাপুরুষেরাই একে সহ্য করতে পারেন, শুধু তাদের পক্ষেই এর কোনো অর্থ নেই। র্যারা মরণকে ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধের্ব তুলতে পেরেছেন জীবন থাকতেই তারা অমৃতলোকে উত্তীৰ্ণ । কিন্তু, মৃত্যুর গুপ্তচর তো শ্ৰদ্ধানন্দের আয়ু হরণ করেই ফিরে যাবে না । ধর্মবিদ্রোহী ধর্মািন্ধতার কাধে চড়ে রক্তকলুষিত যে বীভৎসতাকে নগরের পথে পথে সে বিস্তার করেছিল অনতিকাল পূর্বেই, সে তো আমরা দেখেছি। সে যাদের নষ্ট করেছে তাদের তো কিছুই