পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ჟ(& ხr রবীন্দ্র-রচনাবলী অবশেষ থাকে নি । তাদের মৃত্যু যে নিরতিশয় মৃত্যু, তাদের ক্ষতি যে চরম ক্ষতি । তাদের ঘরে সন্তানহীন মাতার ক্ৰন্দনে সান্তুনা নেই, বিধবার দুঃখে শান্তি নেই । এই-যে নিষ্ঠুরতা যা সমস্তকে নিঃশেষে চিতাভস্মে সমাধা করে, তাকে তো সহ্য করতে পারা যায় না । দুর্বল স্বল্পপ্ৰাণ যারা, যাদের জনসাধারণ বলি, তারা এত বড়ো হিংসার বোঝা বইবে কী করে । এখন দেখতে পাচ্ছি, আবার যমরাজের সিংহদ্বার উদঘাটিত হল, আবার প্রতিবেশীতে প্রতিবেশীতে হত্যার প্রতিযোগিতা আরম্ভ হল । এর দুঃখ সইবে কে । বিধাতা যখন দুঃখকে আমাদের কাছে পাঠান তখন সে একটি প্রশ্ন নিয়ে আসে । সে আমাদের জিজ্ঞাসা করে, তোমরা আমাকে কী ভাবে গ্রহণ করবে । বিপদ আসবে না। এমন হতে পারে নাসংকটের সময় উপস্থিত হয়, আশু উদ্ধারের উপায় থাকে না, কিন্তু, কী ভাবে বিপদকে আমরা ব্যবহার করি তারই উপরে প্রশ্নের সদুত্তর নির্ভর করে । এই-যে পাপ কালো হয়ে দেখা দিল, এর ভয়ে ভীত হব না। এর কাছে মাথা নত করব ? না সে পাপের বিরুদ্ধে পাপকে দাড় করাব ? মৃত্যুর আঘাত, দুঃখের আঘাতের উপর রিপুর উন্মত্ততাকে জাগ্রত করব ! শিশুর আচারে দেখা যায়, সে যখন আছাড়া খায় তখন মেজেকে আঘাত করতে থাকে । যতই আঘাত করে মেজে ততই সে আঘাত ফিরিয়ে দেয় । এ শিশুর ধর্ম | কিন্তু, যদি কোনো বয়স্ক লোক হোচট খায়। তবে সে চিন্তা করে, বাধাটা কোথায়- বাধা যদি থাকে তো সেটা লঙঘন বা সেটাকে অপসারণ করতে হবে । সচরাচর দেখতে পাই বাহির থেকে আকস্মিক আঘাতের চমকে মানুষের শিশুবুদ্ধি ফিরে আসে । সে তখন মনে করে, ধৈর্য অবলম্বন করাই কাপুরুষতা, ক্রোধের প্রকাশ পৌরুষ । আজকের দিনে স্বভাবতই ক্রোধের উদয় হয়ে থাকবে, সে কথা স্বীকার করি । মানবধর্ম তো একেবারে ছাড়তে পারি নে। কিন্তু ক্ৰোধদ্বারা যদি অভিভূত হই। তবে সেও মানবধর্ম নয় । আগুন লেগে পাড়া যদি নিরুপায়ে ভস্ম হয়ে যায়। তবে আগুনের রুদ্রতা নিয়ে আলোচনা করা বৃথা । তখন যদি দোষ কাউকে দিতে হয় তো আগুনকে যেন না দিই । বিপদের কারণ সর্বত্রই থাকে, তার প্রতিকারের উপায় যারা রাখে না তারাই দোষী । যাদের ঘর পুড়েছে তারা যদি বলতে পারে যে, কৃপ খনন করে রাখি নি সেই অপরাধের শাস্তি পেলেম, তা হলে ভবিষ্যতে তাদের ঘর পোড়ার আশঙ্কা কমে । আমাদেরও আজকে তাই বলতে হবে । অপরাধের গোড়ার কথাটা ভাবা চাই ৷ শুনে হয়তো লোকে বলবে, না, এ তো ভালো লাগছে না, একটা প্ৰলয়-ব্যাপার বাধিয়ে দিতে পারলে সাস্তুনা পাওয়া যায় । ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান । যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব । ছাদের পাচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয় । আমাদের সব চেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুৰ্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে, অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত । র রাজ্যে রাজপুরুষদের সঙ্গে আমাদের একটা বাহ্য যোগ থাকে, অথচ আন্তরিক সম্বন্ধ থাকে না । বিদেশীয় রাজত্বে এইটেই আমাদের সব চেয়ে পীড়া দেয় । গায়ে-পড়া যোগটা দুর্বলতা ও অপমান আনে । বিদেশী শাসন সম্পর্কে যদি এ কথা খাটে। তবে স্বদেশীয়দের সম্বন্ধে সে আরো কত সত্য । এক দেশে পাশাপাশি থাকতে হবে, অথচ পরস্পরের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্বন্ধ থাকবে না, হয়তো-বা প্রয়োজনের থাকতে পারে- সেইখানেই যে ছিদ্ৰ— ছিদ্র নয়, কলির সিংহদ্বার । দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যেখানে এতখানি ব্যবধান সেখানেই আকাশ ভেদ করে ওঠে অমঙ্গলের জয়তোরণ । আমাদের দেশে কল্যাণে রথযাত্রায় যখনই সকলে মিলে টানতে চেষ্টা করা হয়েছে কংগ্রেস প্রভৃতি নানা প্রচেষ্টা-দ্বারা, সে রথ কোথায় এসে থেমে যায়, ভেঙে পড়ে ? যেখানে গর্তগুলো হা করে আছে হাজার বছর ধরে । আমাদের দেশে যখন স্বদেশী-আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলেম । মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয় নি, বিরুদ্ধ ছিল ; জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক । জানি, ওরা যোগ দেয় নি । কিন্তু, কেন দেয় নি ।