পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

とかぐう○ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী থেকে যখন প্রথম আঘাত নিয়ে এল মহম্মদ ঘোরী তখন হিন্দুরা সে আসন্ন বিপদের দিনেতেও তো একত্র হয় নি। তার পর যখন মন্দিরের পর মন্দির ভাঙতে লাগল, দেবমূর্তি চূৰ্ণ হতে লাগল, তখন তারা লড়েছে, মরেছে, খণ্ড খণ্ড ভাবে যুদ্ধ করে মরেছে। তখনো একত্র হতে পারল না । খণ্ডিত ছিলেম বলেই মেরেছে, যুগে যুগে এই প্রমাণ আমরা দিয়েছি। কখনো কখনো ইতিহাস উদঘাটন করে অন্য প্রমাণ পাবার চেষ্টা করি বটে ; বলি, শিখরা তো একসময় বাধা ঘুচিয়েছিল । শিখরা যে বাধা ঘুচিয়েছিল সে তো শিখধর্ম দ্বারাই । পাঞ্জাবে কোথাকার জাঠি, কোথাকার কোন জাতি সব, শিখধর্মের আহবানে একত্র হতে পেরেছিল ; বাধাও দিতে পেরেছিল ; ধর্মকেও রক্ষা করতে এক হয়ে দাড়িয়েছিল । শিবাজি একসময় ধর্মব্রিাজ্যস্থাপনের ভিত গেড়েছিলেন । তার যে অসাধারণ শক্তি ছিল তদদ্বারা তিনি মারাঠাদের একত্র করতে পেরেছিলেন । সেই সম্মিলিত শক্তি ভারতবর্ষকে উপদ্রুত করে তুলেছিল । অশ্বের সঙ্গে আশ্বারোহীর যখন সামঞ্জস্য হয় কিছুতেই সে অশ্ব থেকে পড়ে না ; শিবাজির হয়ে সেদিন যারা লড়েছিল তাদের সঙ্গে শিবাজির তেমনি সামঞ্জস্য হয়েছিল । পরে আর সে সামঞ্জস্য রইল না ; পেশোয়াদের মনে ও আচরণে ভেদবুদ্ধি, খণ্ড খণ্ড স্বাৰ্থ বুদ্ধি তীক্ষ হয়ে ক্ষণকালীন রাষ্ট্রবন্ধনকে টুকরো টুকরো করে দিলে । আমার কথা এই যে, আমাদের মধ্যে এই-যে পাপ পুষে রেখেছি। এতে কি শুধু আমাদেরই অকল্যাণ, সে পাপে কি আমরা প্রতিবেশীদের প্রতি অবিচার করি নে, তাদের মধ্যে হিংসা জাগিয়ে তুলি। নে ? যে দুর্বল সেই প্রবলকে প্রলুব্ধ করে পাপের পথে টেনে আনে । পাপের প্রধান আশ্রয় দুর্বলের মধ্যে । অতএব যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মারা খাই— তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা । আপনার জন্যেও, প্রতিবেশীর জন্যেও আমাদের নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে হবে । আমরা প্রতিবেশীদের কাছে আপিল করতে পারি, তোমরা ক্রুব হেগয়ে না, তোমরা ভালো হও, নরহত্যার উপরে কোনো ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না— কিন্তু সে আপিল যে দুর্বলের কান্না | বায়ুমণ্ডলে বাতাস লঘু হয়ে এলে ঝড় যেমন আপনিই আসে, ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না, তেমনি দুর্বলতা পুষে রেখে দিলে সেখানে অত্যাচার আপনিই আসে-— কেউ বাধা দিতে পাবে না । কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটা উপলক্ষ নিয়ে পরস্পরের কৃত্রিম বন্ধুতাবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি, কিন্তু চিবকালের জন্য তা হয় না । যে মাটিতে কণ্টকতরু ওঠে। সে মাটিকে যতক্ষণ শোধন না করা হয় ততক্ষণ তো কোনো ফল হবে না । আপনার লোককেও যে পর করেছে, পরের সঙ্গেও যার আত্মীয়তা নেই, সে তো ঘাটে এসেছে, তার ঘর কোথায় । আর, তার শ্বাসই বা কতক্ষণ । আজ আমাদের অনুতাপের দিন, আজ অপরাধের ক্ষালন করতে হবে । সত্যিকারী প্ৰায়শ্চিত্ত যদি করি তবেই শত্ৰু আমাদের মিত্র হবে, রুদ্র আমাদের প্ৰতি প্ৰসন্ন হবেন । YY S y Sov) “রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত? যখন খবর পাই রাষ্ট্রনীতি সমাজনীতি ধর্মনীতি সম্বন্ধে আমার বিশেষ মত কী তা আমার রচনা থেকে হবে । দলিলের সাক্ষ্যের সঙ্গে উকিলের ব্যাখ্যা জড়িত হয়ে যে জিনিসটা দাড়ায় সেটাকে প্রমাণ বলে গণ্য করা চলে না । কেননা, অন্য পক্ষের উকিলও সেই একই দলিলকে বিপরীত কথা বলিয়ে থাকেন ; তার কারণ, বাছাই-করা বাক্যের বিশেষ অর্থ নির্ভর করে বিশেষরূপে বাছাই করার উপরেই !