পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর Wსტ\ხა রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে আমার মত আলোচনা করে সম্প্রতি ইংরেজি ভাষায় একখানি বই” লেখা হয়েছে । ব্যক্তিগত দিক থেকে আমি লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ ; তিনি আমার প্রতি অসম্মান প্ৰকাশ করবার চেষ্টা করেন নি ; শ্রদ্ধা করেই লিখেছেন । আমার প্রতি তার মনের অনুকুল ভাব থাকাতেই আমার মতকে অনেক অংশে প্রচলিত মতের অনুকুল করে সাজিয়ে আমাকে সাধারণের প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন । বইখানি আমাকে পড়তে হল । কেননা, আমার রাষ্ট্রনৈতিক মত কোনো পাঠকের কাছে কিরকম প্রতীত হয়েছে তা জানিবার কৌতুহল সামলাতে পারি নি । আমি জানি, আমার মত ঠিক যে কী তা সংগ্ৰহ করা সহজ নয় । বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের নানা অবস্থা এবং আমার নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল আমি চিন্তা করেছি এবং কাজও করেছি। যেহেতু বাক্য রচনা করা আমার স্বভাব সেইজন্যে যখন যা মনে এসেছে তখনি তা প্ৰকাশ করেছি { রচনাকালীন সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনের সঙ্গে সেই-সব লেখার যোগ বিচ্ছিন্ন করে দেখলে তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য গ্ৰহণ করা সম্ভবপর হয় না । যে মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে চিন্তা করতে করতে লিখেছে তার রচনার ধারাকে ঐতিহাসিকভাবে দেখাই সংগত । যেমন এ কথা চলে না যে, ব্ৰাহ্মণ আদি চারিবর্ণ সৃষ্টির আদিকালেই ব্ৰহ্মার মুখ থেকে পরিপূর্ণ স্বরূপে প্রকাশ পেয়েছে, যেমন স্বীকার করতেই হবে আর্যজাতির সমাজে বৰ্ণভেদের প্রথা কালে কালে নানা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে পরিণত, তেমনি করেই অন্তত আমার সম্বন্ধে জানা চাই যে, রাষ্ট্রনীতির মতো বিষয়ে কোনো বাধা মত একেবারে সুসম্পূৰ্ণভাবে কোনো এক বিশেষ সময়ে আমার মন থেকে উৎপন্ন হয় নি- জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নানা পরিবর্তনের মধ্যে তারা গড়ে উঠেছে । সেই সমস্ত পরিবর্তন-পরম্পরার মধ্যে নিঃসন্দেহ একটা ঐক্যসূত্ৰ আছে । সেইটিকে উদ্ধার করতে হলে রচনার কোন অংশ মুখ্য, কোন অংশ গৌণ, কোনটা তৎসাময়িক, কোনটা বিশেষ সময়ের সীমাকে অতিক্রম করে প্রবহমান, সেইটে বিচার করে দেখা চাই । বস্তুত সেটাকে অংশে অংশে বিচার করতে গেলে পাওয়া যায় না, সমগ্রভাবে অনুভব করে তবে তাকে পাই । বইখানি পড়ে আমি নিজের মতের ঠিক চেহারাটা পেলুম না । মন বাধা পেল । বাধা পাবার অন্যান্য কারণের মধ্যে একটা কারণ এই যে, এর মধ্যে অনেক তর্জমা আছে যার ভাষা আমার নয়, অথচ আমার যে নয়। তার নিদর্শন নেই । ভাষার ইঙ্গিত অনেকখানি কথা কয় ? সেটা যখন বাদ পড়ে তখন কথার অর্থ পাওয়া যায়, কিন্তু তার ব্যঞ্জনা মারা পড়ে । আর যাই হােক, নিজের ভাষার দায়িত্ব নিজেকে নিতেই হয়। কিন্তু অন্যের ভাষার দায়িত্ব নেওয়া চলে না । তবু এই ত্রুটিকেও উপেক্ষা করা চলে— কিন্তু এ কথা বলতেই হল যে, নানা লেখা থেকে বাক্য চয়ন করে আমার মতের যে একটা মূর্তি দেওয়া হয়েছে তাতে অংশত হয়তো সব কথাই আছে কিন্তু সমগ্ৰত মোট কথাটা প্ৰকাশ পায় নি । এরকমটা হওয়াটা বোধ করি। অবশ্যম্ভাবী । কোন কথাটার গুরুত্ব বেশি কোনটার কম, লেখক সেটা স্বভাবত নিজের অভিমত ও রুচির দ্বারা স্থির করেন এবং সেইভাবেই সমস্তটাকে গড়ে তোলেন । এই উপলক্ষে আমার সমস্ত চিন্তার ক্ষেত্রের উপর নিজেকে একবার দৃষ্টিক্ষেপ করতে হল । রাষ্টিক সমস্যা সম্বন্ধে আমি কী ভেবেছি কী বলতে চেয়েছি তা নিজেই কুড়িয়ে এনে সংক্ষেপে আঁটি বাধিবার চেষ্টা করা ভালো মনে করি । এজন্যে দলিল ঘাটিব না, নিজের স্মৃতির উপবিতলে স্পষ্ট হয়ে যা জেগে আছে তারই অনুসরণ করব । বালককালের অনেক প্রভাব জীবনপথে শেষ পর্যন্ত সঙ্গী হয়ে থাকে ; প্ৰত্যক্ষ না থাকলেও তাদের প্রণোদনা থেকে যায় । আমাদের ব্ৰাহ্ম-পরিবার আধুনিক হিন্দুসমাজের বাহ্য আচার-বিচার ক্রিয়া-কর্মের নানা আবশ্যিক বন্ধন থেকে বিযুক্ত ছিল । আমার বিশ্বাস, সেই কিছু-পরিমাণ দূরত্ব-বশতই ভারতবর্ষের সর্বজনীন সর্বকালীন আদর্শের প্রতি আমার গুরুজনদের শ্রদ্ধা ছিল অত্যন্ত > Sachindranath Sen, Political Philosophy of Rabindranath