পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর SVVS) ইতিমধ্যে কার্জন লাটের হুকুমে দিল্লির দরবারের উদযোগ হল । তখন রাজশাসনের তর্জন স্বীকার করেও আমি তাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলুম। সেই প্ৰবন্ধ যদি হাল আমলের পাঠকরা পড়ে দেখেন। তবে দেখবেন, ইংরেজের সঙ্গে ভারতবাসীর রাষ্টিক সম্বন্ধের বেদনা ও অপমানটা যে কোথায় আমার সেই লেখায় কতকটা প্ৰকাশ করেছি । আমি এই বলতে চেয়েছিলুম, দরবার জিনিসটা প্ৰাচ্যপাশ্চাত্য কর্তৃপক্ষ যখন সেটা ব্যবহার করেন তখন তার যেটা শূন্যের দিক সেইটিকেই জাহির করেন, যেটা পূর্ণের দিক সেটাকে নয়। প্রাচ্য অনুষ্ঠানের প্রাচ্যতা কিসে । সে হচ্ছে দুই পক্ষের মধ্যে আত্মিক সম্বন্ধ স্বীকার করা । তরবারির জোরে প্রতাপের যে সম্বন্ধ সে হল বিরুদ্ধ সম্বন্ধ, আর প্রভূত দক্ষিণ্যের দ্বারা যে সম্বন্ধ সেইটেই নিকটের । দরবারে সম্রাট আপন অজস্র ঔদার্য প্ৰকাশ করবার উপলক্ষ পেতেন- সেদিন তার দ্বার অবারিত, তার দান অপরিমিত । পাশ্চাত্য নকল দরবারে সেই দিকটাতে কঠিন কৃপণতা, সেখানে জনসাধারণের স্থান সংকীর্ণ, পাহারাওয়ালার অস্ত্ৰে শস্ত্রে রাজপুরুষদের সংশয়বুদ্ধি কণ্টকিত— তার উপরে এই দরবারের ব্যয় বহনের ভার দববারের অতিথিদেরই পরে । কেবলমাত্র নতমস্তকে রাজার প্রতাপকে স্বীকার করাবার জনোই এই দরবার । উৎসবের সমাবোহ-দ্বারা পরস্পরের সম্বন্ধের অন্তর্নিহিত অপমানকেই আড়ম্বর করে বাইরে প্রকাশ করা হয় । এই কৃত্রিম হৃদয়হীন আড়ম্বরে প্রাচ্যহাদয় অভিভূত হতে পারে, এমন কথা চিন্তা করার মধ্যেও অবিমিশ্র ঔদ্ধত্য এবং প্রজার প্রতি অপমান । ভারতবর্ষে ইংরেজের প্রভুত্ব তার আইনে, তার মন্ত্ৰগৃহে, তাব শাসনতন্ত্রে ব্যাপ্তভাবে আছে কিন্তু সেইটোকে উৎসবের আকার দিয়ে উৎকট করে তোলার কোনো প্রয়োজন মাত্রই নেই । বরঞ্চ এইরকম কৃত্রিম উৎসবে স্পষ্ট করে প্রকাশ করে দেওয়া হয় যে, ভারতবর্ষে ইংরেজ খুব কঠিন হয়ে আছে, কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের মানব সম্বন্ধ নেই, যান্ত্রিক সম্বন্ধ ! এ দেশের সঙ্গে তার লাভের যোগ আছে, ব্যবহারের যোগ আছে, হৃদয়ের যোগ নেই । কর্তব্যের জালে দেশ আবৃত, সেই কর্তব্যের নৈপুণ্য এবং উপকারিতা স্বীকার করলেও আমাদের মানবপ্রকৃতি স্বভাবতই সেই প্ৰাণহীন শাসনতন্ত্রে পীড়া বোধ করে । এই বেদনাই মনে নিয়ে আমার লেখায় আমি বিশেষ করে এবং বার বার করে বলেছি যে, ভারতবাসী যদি ভারতবর্ষের সকলপ্রকার হিতকর দান কোনো একটি প্রবল শক্তিশালী যন্ত্রের হাত দিয়েই চিরদিন গ্ৰহণ করতে অভ্যস্ত হয়, তা হলে তার সুবিধা সুযোগ যতই থােক, তার চেয়ে দুৰ্গতি আমাদের আর হতেই পারে না । সরকারবাহাদুর-নামক একটা অমানবিক প্রভাব ছাড়া আমাদের অভাবনিবারণের আর কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। এইরকম ধারণা মনে বদ্ধমূল হতে দেওয়াতেই আমরা নিজের দেশকে নিজে যথার্থভাবে হারাই। আমাদের নিজের দেশ যে আমাদের নিজের হয় নি। তার প্রধান কারণ এ নয় যে, এ দেশ বিদেশীর শাসনাধীনে । আসল কথাটা এই যে, যে দেশে দৈবক্রমে জন্মেছি মাত্র সেই দেশকে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা, তপস্যা-দ্বারা, জানার দ্বারা, বোঝার দ্বারা সম্পূৰ্ণ আত্মীয় করে তুলি নি- একে অধিকার করতে পারি নি। নিজের বুদ্ধি দিয়ে, প্ৰাণ দিয়ে, প্ৰেম দিয়ে যাকে গড়ে তুলি তাকেই আমরা অধিকার করি ; তারই পরে অন্যায় আমরা মরে গেলেও সহ্য করতে পারি। নে । কেউ কেউ বলেন, আমাদের দেশ পরাধীন বলেই তার সেবা সম্বন্ধে দেশের লোক উদাসীন । এমন কথা শোনবার যোগ্য নয় । সত্যকার প্ৰেম অনুকুল প্রতিকূল সকল অবস্থাতেই সেবার ভিতর দিয়ে স্বতই আত্মত্যাগ করতে উদ্যত হয় । বাধা পেলে তার উদ্যম বাড়ে বৈ কমে না । আমরা কনগ্রেস করেছি, তীব্র ভাষায় হৃদয়াবেগ প্রকাশ করেছি, কিন্তু যে-সব অভাবের তাড়নায় আমাদের দেহ রোগে জীৰ্ণ, উপবাসে শীর্ণ কর্মে অপুট, আমাদের চিত্ত অন্ধসংস্কারে ভারাক্রান্ত, আমাদের সমাজ শতখণ্ডে খণ্ডিত, তাকে নিজের বুদ্ধির দ্বারা, বিদ্যার দ্বারা, সংঘবদ্ধ চেষ্টা-দ্বারা দূর করবার কোনো উদযোগ করি নি। কেবলই নিজেকে এবং অন্যকে এই বলেই ভোলাই যে, যেদিন স্বরাজ হাতে আসবে তার পরদিন থেকেই সমস্ত আপনিই ঠিক হয়ে যাবে । এমনি করে কর্তব্যকে সুদূরে ঠেকিয়ে রাখা, অকৰ্মণ্যতার শূন্যগর্ভ কৈফিয়ত রচনা করা, নিরুৎসুক নিরুদ্যম দুর্বল চিত্তেরই