পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

222 রবীন্দ্র-রচনাবলী হিন্দু-মুসলমান ভারতবর্ষের সকল প্রদেশের সকল সমাজের ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত এক মহাজাতিকে জাগিয়ে তুলে একচ্ছত্ৰ আসন রচনা করব বলে দেশনেতারা পণ করেছেন । ঐ আসন জিনিসটা অর্থাৎ যাকে বলে কনস্টিটুৰ্দশ্যন, ওটা বাইরের, রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থায় আমাদের পরস্পরের অধিকার-নির্ণয় দিয়ে সেটা গড়েপিটে তুলতে হবে । তার নানা রকমের নমুনা নানা দেশের ইতিহাসে দেখেছি, তারই থেকে যাচাই বাছাই করে প্ল্যান ঠিক করা চলছে । এই ধারণা ছিল, ওটাকে পাকা করে খাড়া করবার বাধা বাইরে, অর্থাৎ বর্তমান কর্তৃপক্ষদের ইচ্ছার মধ্যে । তারই সঙ্গে রফা করবার, তকরার করবার কাজে কিছুকাল থেকে আমরা উঠে পড়ে লেগেছি । যখন মনে হল কাজ এগিয়েছে, হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে দেখি, মস্ত বাধা নিজেদের মধ্যেই । গাডিটাকে তীর্থে পৌঁছে দেবার প্রস্তাবে সারথি, যদি-বা আধ-রাজি হল ওটাকে আস্তাবল থেকে ঠেলে বের করবার সময় ছশ হল, এক্কা গাড়িটার দুই চাকায় বিপরীত রকমের অমিল, চালাতে গেলেই উলটে পড়বার জো হয় | যে বিরুদ্ধ মানুষটার সঙ্গে আমাদের বাইরের সম্বন্ধ, বিবাদ করে একদিন তাকে হটিয়ে বাহির করে দেওয়া দুঃসাধ্যা হলেও নিতান্ত অসাধ্য নয়, সেখানে আমাদের হারজিতের মামলা । কিন্তু ভিতরের লোকের বিবাদে কোনো এক পক্ষ জিতলেও, মোটের উপর সেটা হার, আর হারলেও শান্তি নেই । কোনো পক্ষকে বাদ দেবারও জো নেই, আবার দাবিয়ে রাখতে গেলেও উৎপাতকে চিরকাল উত্তেজিত করে রাখাই হবে । ডান পাশের দাত বা পাশের দাতকে নড়িয়ে দিয়ে যদি বড়াই করতে চায়। তবে অবশেষে নিজে অনড় থাকবে না । এতদিন রাষ্ট্রসভায় বরসজাটার পরেই একান্ত মন দিয়েছিলুম, আসনটা কেমন হবে এই কথা ভেবেই মুগ্ধ। ওটা মহামূল্য ও লোভনীয়। প্রতিবেশীরা যারা কিংখাবের আসন বানিয়েছে তাদের আসরের ঘটা দেখে ঈৰ্ষা হয় । কিন্তু হায় রে, স্বয়ং বরকে বরণ করবার আস্তরিক আয়োজন বহুকাল থেকে ভুলেই আছি । আজ তাই পণ নিয়ে বরযাত্রীদের লড়াই বাধে । শুভকর্মে অশুভ গ্রহের শাস্তির কথাটায় প্রথম থেকেই মন দিই নি, কেবল আসনটার মালমসলার ফর্দ নিয়ে বেলা বইয়ে দিয়েছি । রাষ্টিক মহাসন-নির্মাণের চেয়ে রাষ্টিক মহাজাতি-সৃষ্টির প্রয়োজন আমাদের দেশে অনেক বড়ো, এ কথা বলা বাহুল্য । সমাজে ধর্মে ভাষায় আচারে আমাদেব বিভাগের অন্ত নেই | এই বিদীর্ণতা আমাদের রাষ্ট্রিক সম্পূর্ণতার বিরোধী ; কিন্তু তার চেয়ে অশুভের কারণ এই যে, এই বিচ্ছেদে আমাদের মনুষ্যত্ব-সাধনার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে ; মানুষে মানুষে কাছাকাছি বাস করে। তবু কিছুতে মনের মিল হয় না, কাজের যোগ থাকে না, প্ৰত্যেক পদে মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়, এটা বর্বরতার লক্ষণ । অথচ আমরা যে আত্মশাসনের দাবি করছি সেটা তো বর্বরের প্রাপ্য নয় । যাদের ধর্মে সমাজে প্রথায়, যাদের চিত্তবৃত্তির মধ্যে, এমন একটা মজাগত জোড়-ভাঙানো দুৰ্যোগ আছে যে তারা কথায় কথায় একখানাকে সাতখানা করে ফেলে, সেই ছত্ৰভঙ্গের দল ঐকরাষ্ট্রিক সত্তাকে উদ্ভাবিত করবে। কোন যন্ত্রের সাহায্যে | যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অনা কোনো বাধনে তাকে বাধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য ! সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ । মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটােকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি । যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বাৰ্থ বুদ্ধি কি সে দেশকে বাচাতে পারে । ইতিহাসে বারে বারে দেখা গেছে, যখন কোনো মহাজাতি নবজীবনের প্রেরণায় রাষ্ট্রবিপ্লব প্রবর্তন করেছে তার সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার ধর্মবিদ্বেষ। দেড়শত বৎসর পূর্বকার ফরাসি বিপ্লবে তার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে । সোভিয়েট রাশিয়া প্রচলিত ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে বদ্ধপরিকর । সম্প্রতি