পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

=== م 2 - () রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমরা পাশাপাশি চলি, কাছাকাছি আসি, তা হলেই দেখতে পাব, মানুষ বলেই মানুষকে আপনি বলে মনে কবা সহজ । যাদেব সঙ্গে মেলামেশা নেই তাদেব সম্বন্ধেই মত প্রভূতিৰ অনৈক্য অত্যন্ত কড়া হযে ওঠে, বড়ো হযে দেখা দেয় । যখনই পৰস্পর কাছাকাছি আনাগোনার চর্চা হতে থাকে তখনই মত পিছিয়ে পডে, মানুষ সামনে এগিয়ে আসে । শান্তিনিকেতনে মাঝে মাঝে মুসলমান ছাত্র ও শিক্ষক এসেছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো প্ৰভেদ অনুভব কবি নি এবং সখা ও সেহসম্বন্ধ-স্থাপনে লেশমাত্র বাধা ঘটে নি । যে-সকল গ্রামের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সম্বন্ধ তাব মধ্যে মুসলমান গ্রাম আছে । যখন কলকাতায্য হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা দাঁত-সহযোগে কলকাতার বাইরে ছডিয়ে চলেছে তখন বোলপুর-অঞ্চলে মিথ্যা জনরব বাষ্ট্র করা হযেছিল যে, হিন্দুবা মসজিদ ভেঙে দেবাব সংকল্প করছে, এইসঙ্গে কলকাতা থেকে গুণ্ডার আমদানিও হয়েছিল । কিন্তু, স্থানীয মুসলমানদেব শান্ত রাখতে আমাদের কোনো কষ্ট পেতে হয নি, কেননা তারা নিশ্চিত জানত আমরা তাদের আকৃত্রিম বন্ধ ! আমার অধিকাংশ প্ৰজাই মুসলমান ! কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্ৰবল তখন হিন্দু প্ৰজাবা আমাদের এলাকায সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল । সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে কবি নি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন কিবা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিলে । আমাদেব সেখানে এপর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি । আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমাব সঙ্গে আমাব মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন । এ কথা আশা করাই চলে না যে, আমাদের দেশেব ভিন্ন ভিন্ন সমাজেব মধ্যে ধমকমেব মতবিশ্বাসের ভেদ একেবাবেই ঘূচিতে পারে । তবুও মনুষ্যত্নেব খাতিরে আশা করতেই হবে আমাদের মধ্যে মিল হবে । পরস্পরকে দূরে না বাখলেই সে মিল আপনিই সহজ হতে পারবে । সঙ্গের দিক থেকে আজকাল হিন্দু-মুসলমান পৃথক হযে গিযে সাম্প্রদায়িক অনৈক্যাকে বাডিযে তুলেছে, মনুষ্যত্বেৰ মিলিটাকে দিযেছে চাপা ! আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মুসলমানের ত্রুটিবিচারটা থাক— আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজা স্বীকাৰ করি । অল্পবয সে যখন প্রথম জমিদাবি সে বেস্তা দেখতে গিযেছিলুম। তখন দেখলুম, আমাদের ব্ৰাহ্মণ ম্যানেজার যে তক্তপোষে গাদিতে বসে দরবাব করেন সেখানে এক ধাবি জাজিম তোলা, সেই জায়গাটা মুসলমান প্রজাদেব বসবার জনো আব্ব জাজিমের উপর বসে হিন্দু প্ৰজাৱা | এইটে দেখে আমার ধিক্কার জন্মেছিল । অথচ এই ম্যানেজার আধুনিক দেশাত্মবোধী দলের । ইংবেজরাজেব দববারে ভারতীয়ের অসম্মান নিয়ে কটুভাষা ব্যবহাব তিনি উপভোগ করে থাকেন, তবু স্বদেশীয়কে ভদ্রোচিত সম্মান দেবার বেলা এত কৃপণ | এই কৃপণতা সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে অনেকদূর পর্যন্ত প্ৰবেশ করেছে ; অবশেষে এমন হয়েছে যেখানে হিন্দু সেখানে মুসলমানের দ্বার সংকীর্ণ, যেখানে মুসলমান সেখানে হিন্দুর বাধা বিস্তব ! এই আন্তবিক বিচ্ছেদ যতদিন থাকবে ততদিন স্বার্থের ভেদ ঘুচিবে না এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক পক্ষেব কল্যাণভার অপর পক্ষের হাতে দিতে সংকোচ অনিবার্য হযে উঠবে । আজি সম্মিলিত নির্বাচন নিয়ে যে দ্বন্দ্ৰ বেধে গেছে তার মূল তো এইখানেই । এই দ্বন্দ্ব নিয়ে যখন আমরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠি তখন এর স্বাভাবিক কারণটার কথা ভেবে দেখি না কেন । ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অকথা বর্বরতা বাবে বারে আমাদের সহ্য করতে হয়েছে । জার-শাসনেব আমলে এইরকম অত্যাচার রাশিয়ায় প্রায় ঘটত । বর্তমান বিপ্লবপ্রবণ পলিটিক্যাল যুগের পূর্লে আমাদের দেশে এরকম দানবিক কাণ্ড কখনো শোনা যায় নি । ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে বহু গৌরবের law and (order পদার্থটা বড়ো বড়ো শহরে পুলিস-পাহারার জাগ্ৰত দৃষ্টির সামনে স্পর্ধাসহকারে উপরি উপরি অবমানিত হতে লাগল ঠিক এই বিশেষ সময়টাতেই । মারের দুঃখ কেবল আমাদেব পিঠের উপর দিয়েই গেল না, ওটা প্ৰবেশ করেছে বুকের ভিতরে । এটা এমন সময়ে ঘটল ঠিক যখন হিন্দু-মুসলমান কণ্ঠ মিলিযে দাড়াতে পারলে আমাদের ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন হত, বিশ্বসভার কাছে আমাদের মাথা হেঁট হত না । এইরকমের অমানুষিক ঘটনায় লোকস্মৃতিকে চিবদিনের মতো বিষাক্ত করে তোলে,