পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালাস্তব ۹ ما C আমার সেদিনকাব চমক আজ ও ভাঙবার সময় আসে নি । যারা যে কারণেই হোক আইন ভেঙে অপরাধীর শ্রেণীতে গণ্য হয়েছে তাদের সম্বন্ধে এমন একটা সংস্কার বদ্ধমল হযে গেছে যে, তাদের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার করতে মন বাধা পায় না । ধরে বেখেছি তারা আমাদের মতো নয় ; আর যারা আমাদের মতো নয়। তাদের প্রতি আচরণ অত্যাচার হয়ে উঠলে সমস্ত সমাজেরই যেন সমর্থন পাওয়া যায় { সমাজের গাঢ় অন্তরে যে নির্দয় প্রবৃত্তি আছে তাই চরিতার্থ করবার উপলক্ষ হয়ে ওঠে। এরা । আমাৰ আর-একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, এ ঘটেছিল। পরেব বয়সে । একদিন কোলকাতার রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম, পলিস একজন আসামীকে- সে অপরাধ করে থাকতেও পারে, নাও পারেকোমরে দড়ি দিযে বেধে টেনে নিয়ে চলেছে সমস্ত রাস্তার জনতার মাঝখান দিয়ে । মানুষকে এমন জন্তুব মতো কবে বেধে নিয়ে যাওয়া, এতে আমাদের সকলেরই অপমান । আমার মনে এটা এত যে লেগেছিল তার একটা কাবণ, এবাকাম কৰ্দশ্য আমি ইংলন্ডে বা যুরোপের আর-কোথাও দেখি নি । এর মধ্যে দুটাে আঘাত একত্রে ছিল— এক হচ্ছে মানুষের প্রতি অপমান ; আর-এক, বিশেষভাবে আমার দেশের লোকের প্রতি অপমান— এক হচ্ছে আইনভাঙা অপবাধীব প্ৰতি নির্দয়তা ; আর-এক, আমাদের স্বদেশীয় অপরাধীব প্রতি অবজ্ঞা । সতবাং সেই অবজ্ঞাব ভাগী আমরা সকলেই । আমাদের দেশেই বিধিনির্দিষ্ট দণ্ডপ্রয়োগের অতিরিক্ত অপমান-প্ৰয়োগ সমস্ত জগতকে লাঞ্ছিত করে । নিদিয প্ৰণালী যে কাৰ্যকৰী, এই ধারণা বর্বব প্ৰবৃত্তিব স্বভাবসংগতি | পাঠশালা থেকে আরম্ভ করে পাগলাগবিদ পর্যন্ত এবং ক্ৰিযা দেখা যায় ! এবা প্ৰধান কাবণ মানুষের মনে যে বর্বর মবে নি নির্দয়তায় সে বস পায ! সভা দেশে সেই রসসম্ভোগের স্থান সংকীর্ণ হযে এসেছে । তাব কারণ, কালক্রমে মানুষ খানিকটা সভা হযেছে, সেই খানিকটা-সভা মানুষ আপনার ভিতরকাব বর্বর মানুষকে লজ্জা দেয় এবং সংযত করে । যেখানে সেই সংযমের দাবি নেই সেখানে বর্বব সম্পৰ্ণ ছাড়া পায, নির্দয়তাই বৈধ হয়ে ওঠে । জেলখানাম মনুষ্যত্নেব আদর্শ বর্বরের দ্বারা প্রতিদিন পীডিত হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই । সমাজের দুষ্ট প্রবৃত্তি শোধনের কর্তব্যতা অনেক বেশি অতিক্রম কবে প্ৰতিহিংসা চরিতার্থ করবার বর্বব ধর্ম যদি জেলখানা আশ্ৰয করে না থাকত, তা হলে ওখান থেকে দণ্ডবিধির দুর্বিষহ উগ্রতা লজিত হয়ে চলে যেত । পাপকে সমাজের যে-কোনো জাযগাতেই ছোটো-বডে যে-কোনো আকাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায, তলে তলে সে আপন সীমা বাডিয়ে চলতে থাকে । তারই কুৎসিত দৃষ্টান্ত দেখতে পাই আধুনিক যুরোপে । সেখানে সভ্যনামধারী বডো বডো দেশে শাস্তিদানের দানবিক দন্তবিকাশ নির্মম স্পর্ধাব সঙ্গে সর্বত্র সভাতাকে যেরকম বিদ্রুপ করতে উদ্যত হয়েছে, তার মূল রয়েছে সকল দেশের সব জেলখানাতেই ; অনেক কাল থেকে অনেক খরচ করে সয়তানকে মানুষের রক্ত খাইযে পুষে বাখবার জন্যে বড়ো বড়ো পিঞ্জাব রাখা হয়েছে ! হিংস্রতার ঠগিধর্ম-উপাসক ফসিজমের জন্মভূমিই হচ্ছে সভ্যতার আত্মবিরোধী এই-সব জেলখানায় । এই-সব শাসনকেন্দ্র আপনি আশেপাশে মনুষ্যত্বের কিরকম বিকৃতি ঘটাতে থাকে তার একটা দৃষ্টান্ত অনেক দিন পরে আমি আজও ভুলতে পারি, নি । চীনযাত্রাকালে আমাদের জাহাজ পৌঁছল হংকং বন্দরে । জাহাজের ডেকে দাড়িযে দেখলুম, একজন চীনা ফেরিওয়ালা জাহাজের যাত্রীদের কাছে পণ্য বিক্রি করবার চেষ্টায় তীরে এসেছিল । তাদেব নিষেধ করবাব নিয়ম হযতো ছিল । সেই কর্তব্য পালনের উপলক্ষে দেখলুম, আমাদের স্বদেশীয় শিখ কনস্টেবল তার বেণী ধরে টেনে অনায়াসে তাকে লাথি মারলে | কািঢ়তা কবার ঔদ্ধতোর যে আনন্দ আদিম অসংস্কৃত বুদ্ধির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে দণ্ডনীতির অসভ্যতাই তাকে অবারিত করার সুযোগ দেয় । মনে মনে কল্পনা করলুম, একজন যুরোপীয়- সে ফেরিওয়ালা নয়, হয়তো সে চোর, সে প্ৰতারক, সে দুৰ্বত্ত— তাকে ঐ শিখ কনস্টেবল গ্রেফতার করত, কর্তব্যের অনুরোধে মাথায় এক ঘা লাঠিও বসাতে পারত, কিন্তু তাকে কানে ধরে লাথি মারতে পারত না । ঐ কনস্টেবল নিষেধ করেছিল ফেরিওয়ালাকে, লাথি মেরেছিল সমস্ত জাতকে | অবজ্ঞাভাজন জাতির মানুষ কেবল যে অপমান ভোগ করে তা নয়, সহজেই তার সম্বন্ধে দণ্ডের কঠোরতা প্ৰবল হয়ে ওঠে । হয় যে, তার কারণ