পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় 2S (? ‘রাজপুতানা” কবিতাটির রচনা -প্রসঙ্গে মৈত্ৰেয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্ৰন্থ হইতে রবীন্দ্রনাথের কয়েক ছত্র উক্তি উদধূত করা হইল— ... ঐ যে বইটা দিয়েছে না, স্টেটসম্যানের ‘সুন্দর ভারত’, ওব মধ্যে দেখছিলাম রাজপুতানার ছবি । দেখেই মনে হল, হায় হায় এই কি সেই রাজপুতানা ? মৃত্যুর বোঝা বহন ক'রে তবু বেঁচে আছে । এর চেয়ে তাব ধ্বংস ছিল ভালো । কোনো একরকমের জীবনের চাইতে মরণই মঙ্গল, মরণই সম্মানের । —মংপুতে রবীন্দ্রনাথ । প্রথম মুদ্রণ, পৃ. ৩৭ ১৩৪০ সালে বিহার-ভূমিকম্পের দুর্গতদের সাহায্য-কল্পে প্রধানত প্ৰবোধেন্দুনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে কলিকাতায় রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর অভিনয় হইয়াছিল । “ভূমিকম্প” কবিতাটি সেই উপলক্ষে রচিত ও প্রেরিত হয় । মৌলানা জিয়াউদ্দীন বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনে ইসলামীয় সংস্কৃতিক অধ্যাপক ছিলেন । তাহার অকালমৃত্যু ঘটিলে শান্তিনিকেতনে শোকসভায় রবীন্দ্রনাথের যে ভাষণ প্রদত্ত হয় তাহার অনুলিপি মৌলানা জিয়াউদ্দীন” কবিতার পরিপূরক-স্বরূপ ১৩৪৫ শ্রাবণের প্রবাসী হইতে নিম্নে মুদ্রিত হইল— মৌলানা জিয়াউদ্দীন আজকের দিনে একটা কোনো অনুষ্ঠানের সাহায্যে জিয়াউদ্দীনের অকস্মাৎ মৃত্যুতে আশ্রমবাসীদের কাছে বেদনা প্ৰকাশ করব, এ কথা ভাবতেও আমার কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে । যে অনুভূতি নিয়ে আমরা একত্র হয়েছি তার মূলকথা কেবল কর্তব্যপালন নয়, এ অনুভূতি আরো অনেক গভীর । জিয়াউদ্দীনের মৃত্যুতে যে স্থান শূন্য হল তা পূরণ করা সহজ হবে না, কারণ তিনি সত্য ছিলেন । অনেকেই তো সংসারের পথে যাত্রা করে, কিন্তু মৃত্যুর পরে চিহ্ন রেখে যায় এমন লোক খুব কমই মেলে । অধিকাংশ লোক লঘুভাবে ভেসে যায় হালকা মেঘের মতো । জিয়াউদ্দীন সম্বন্ধে সে কথা বলা চলে না ; আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তিনি যে স্থান পেয়েছেন তা নিশ্চিহ্ন হয়ে একদিন একেবারে বিলীন হয়ে যাবে। এ কথা ভাবতে পারি। নে । কারণ, তার সত্তা ছিল সত্যের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ৷ আশ্রম থেকে বাইরে গিয়েছিলেন তিনি ছুটিতে, তার এই ছুটিই যে শেষ ছুটি হবে অদৃষ্টের এই নিষ্ঠুর লীলা মন মেনে নিতে চায় না । তিনি আজ পৃথিবীতে নেই সত্য, কিন্তু তার সত্তা ওতপ্ৰোত ভাবে আশ্রমের সব-কিছুর সঙ্গে মিশে রইল । তিনি প্ৰথমে আশ্রমে এসেছিলেন বালক বয়সে ছাত্র হিসাবে, তখন হয়তো তিনি ঠিক তেমন ক’রে মিশতে পারেন নি এই আশ্রমিক জীবনের সঙ্গে যেমন পরিপূর্ণ ভাবে মিশেছিলেন। পরবতী কালে । কেবল যে আশ্রমের সঙ্গে তার হৃদয় ও কর্মপ্রচেষ্টার সম্পূৰ্ণ যোগ হয়েছিল তা নয়, তার সমস্ত শক্তি এখানকার আবহাওয়ায় পরিণতি লাভ করেছিল । সকলের তা হয় না | র্যারা পরিণতির বীজ নিয়ে আসেন তারাই কেবল আলো থেকে হাওয়া থেকে পরিপক্কতা আহরণ করতে পারেন । এই আশ্রমে যা সত্য যা শ্রেষ্ঠ সেটুকু জিয়াউদ্দীন এমনি করেই পেয়েছিলেন । এই শ্রেষ্ঠতা হল মানবিকতার, আর এই সত্য হল আপনাকে সকলের মধ্যে প্রসারিত ক’রে দেবার শক্তি ॥ ধর্মের দিক থেকে এবং কর্মের দিকে অনেকের সঙ্গেই হয়তো তার মূলগত প্ৰভেদ ছিল, কিন্তু হৃদয়ের বিচ্ছেদ ছিল না । তার চলে যাওয়ার বিশ্বভারতীর কর্মক্ষেত্রে যে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, সেটা পূরণ করা যাবে না । আশ্রমের মানবিকতার ক্ষেত্রে তার জায়গায় একটা শূন্যতা চিরকালের জন্যে রয়ে গেল । তার অকৃত্রিম অন্তরঙ্গতা, তার মতো তেমনি ক’রে কাছে আসা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না, সংকোচ এসে পরিপর্ণ সংযোগকে বাধা দেয় । কর্মের ক্ষেত্রে যিনি কমী হৃদয়ের দিক থেকে যিনি ছিলেন বন্ধু, আজ তারই অভাবে আশ্রমের দিক থেকে ও ব্যক্তিগত ভাবে আমরা একজন পরম সুহৃদকে হারালাম ।