পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Հ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ফলও নষ্ট হয় । তাতে বর্তমানকে ভোলাতে গিয়ে ভবিষ্যৎকে মাটি করি । —প্রবাসী । অগ্রহায়ণ ১৩৩০, পৃ. ১৬০ গ্রস্তুে-মুদ্রিত ‘সমাধান' প্ৰবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদের (পৃ. ৬১১) পরে প্রবাসীতে ছিল— সৌভাগ্যক্রমে অনেক কাল পরে একটা সৰ্দষ্টান্ত আমাদের হাতের কাছে এসেছে , সেটা সম্বন্ধে আলোচনা করলে আমার কথাটা পরিষ্কার হবে - বাংলা দেশ ম্যালেরিয়ায় মরছে । সে মারা কেবল দেহের মারি নয়, এই রোগে সমস্ত দেশটাকে মন-মরা করে দিয়েছে । আমাদের মানসিক অবসাদ, চারিত্রিক দৈন্য, অধ্যবসায়ের অভাব এই রোগজীৰ্ণতার ফল । ম্যালেরিয়া থেকে যদি আমরা উদ্ধার পাই তা হলে কেবল-যে আমরা সংখ্যা হিসাবে বাড়ব তা নয়, শক্তি হিসাবে বেড়ে উঠব । তখন কেবল-যে দুইজনের কাজ একজনে করতে পারব তাও নয়, এমন প্রকৃতির কাজ এমন ধরনে করতে পারব যা এখন পারি। নে ; অর্থাৎ, কেবল যে কাজের পরিমাণ বাড়বে তা নয়, কাজের উৎকর্ষ বাড়বে । তাতে সমস্ত দেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে । এ কথা সকলেই জানি, সকলেই মানি--- কিন্তু সেই সঙ্গে এতকাল এই কথাই মনে লেগে রয়েছে যে, বাংলা দেশ থেকে ম্যালেরিয়া দূর করে দেওয়া বা এই রোগের হ্রাস করা অসম্ভব । বাংলা দেশ ক্ৰমে ক্ৰমে নির্মানুষ হতে পারে, কিন্তু নিৰ্মশক হবে কী করে । অতএব অদৃষ্টে যা আছে তাই হবে । এমন সময়ে একজন সাহসিক বলে উঠলেন, দেশ থেকে মশা তাড়াবার ভার আমি নিলুম। এত বড়ো কথা বলবার ভরসাকেই তো আমি যথেষ্ট মনে করি । এই গুরু-মানা অবতার-মানা দেশে এত বড়ো বুকের পাটা তো দেখতে পাওয়া যায় না । এক-একটি গ্রাম নিয়ে তিনি কাজ আরম্ভ করেছেন । একটি গ্রামেও যদি তিনি ফল পান তা হলে সমস্ত দেশব্যাপী ব্যাধির মূলে কুঠারাঘাত করা হবে । এইটুকুমাত্র কাজই তার যথার্থ কাজ, মহৎ কাজ । কোনো একটিমাত্র জায়গায় যদি তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন যে বিশেষ উপায়ে রোগের বাহনকে দূর করে দেওয়া যেতে পারে তা হলেই হল । স্বহস্তে তিনি নিজের চেষ্টায় সমস্ত অলস দেশকে নীরোগ করে দেবেন। এটা কল্যাণকর নয় । দুষ্টান্তদ্বারা তিনি যেটা প্ৰমাণ করবেন। সেইটেকে দেশ স্বয়ং গ্রহণ করলে তবেই সে উপস্থিত বিপদ থেকে রক্ষা পাবে এবং ভাবী বিপদের বিরুদ্ধে চিরকালের মতো প্ৰস্তুত হবে । নইলে বারে বারে নূতন নূতন ‘ডাক্তার গোপাল চাটুজ্জে’র জন্যে তাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে, আর ইতিমধ্যে তার পিলে-যকৃতের সাংঘাতিক উন্নতিসাধনে সে পৃথিবীর সকল দেশকে ছাডিয়ে যাবে । ম্যালেরিয়া যেমন শরীরের, অবুদ্ধি তেমনি মনের একটা বিষম ব্যাধি ! এতে মানুষের মূল্য কমিয়ে দেয় । অর্থাৎ গুনতি হিসাবে তার পরিমাণ বাড়লেও গুণের হিসাবে অত্যন্ত কমে যায় । স্বরাজ বল, সভ্যতা বল, মানুষের যা-কিছু মূল্যবান ঐশ্বৰ্য সমস্তই এই গুণের হিসেবের উপরেই নির্ভর করে । বালুর পরিমাণ যতই বেশি হোক-না কেন, তাতে মাটির গুণ নেই বলেই ফসল ফলাতে পারে না । ভারতবর্ষের ত্রিশকোটি মানুষের মন পরিমাণ হিসাবে প্ৰভূত, কিন্তু যোগ্যতা হিসাবে কতই স্বল্প । এই অযোগ্যতার এই অবুদ্ধির জগদ্দল পাথরটাকে ভারতবর্ষের মনের উপর থেকে ঠেলে না ফেললে বিধাতা আমাদের কোনো বর দিলেও তা সফল হবে না। এ যদি সত্য হয় তবে আমাদের কোমর বেঁধে বলতেই হবে, এই আমাদের কাজ ! এ কাজ প্ৰত্যেক কমীকে তার হাতের কাছ থেকেই শুরু করতে হবে । যেখানেই যতটুকুই সফলতা লাভ করবেন। সেই সফলতা সমস্ত দেশের । আয়তন থেকে যারা সফলতার বিচার করেন তারা ক্ষুন্ন হবেন, সত্যতা থেকে ধারা বিচার করেন তারা জানেন যে, সত্য বামনরপে এসে বলির কাছ থেকে ত্ৰিভুবন অধিকার করে নিতে পারেন ।