পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܐܰ) ܓ বিনোদবিহারী। রাম! কেবল কতকগুলো মনুষ্যমূর্তি দেখে আসা, তাও আবার প্রায়ই চেনা লোক । চন্দ্ৰকান্ত। তবে এক কাজ করা যাক। চলো আমরা বোষ্টম ভিক্ষুক সেজে বেরিয়ে পড়ি— দেখি তিনটে প্রাণী সমস্ত দিন শহরে কত ভিক্ষে কুড়োতে পারি। বিনোদবিহারী। কথাটা মন্দ নয়, কিন্তু বড়ো ল্যাঠা । চন্দ্ৰকান্ত । তা হলে আর-একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে— বিনোদবিহারী। কী বলো দেখি । চন্দ্ৰকান্ত । যেমন আছি। এমনিই বসে থাকি । বিনোদবিহারী। ঠিক বলেছ। সেটা এতক্ষণ আমার মাথায় আসে নি। আজ তবে এমনি বসে থাকাই যাক। দেখো দেখি চন্দর, একে কি বেঁচে থাকা বলে। সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত কেবল কালেজ যাচ্ছি, আইন পড়ছি, আর সেই পটলডাঙার বাসার মধ্যে পড়ে পড়ে ট্রামের ঘড়ঘড় শুনছি। হগুার মধ্যে একটার বেশি রবিবার আসে না, তাও কিসে খরচ করব ভেবে পাওয়া যায় না। বলো দেখি বিনন্দ । বিনোদবিহারী। তবে সত্যি কথা বলব। আঁ্যা! একটি রাঙা পাড়, একটু মিষ্টি হাসি, দুটাে নরম কথা— তার থেকে ক্ৰমে দীর্ঘনিশ্বাস, ক্রমে অশ্রািজল, ক্ৰমে ছটফটানি— চন্দ্ৰকান্ত । এমন-কি, আত্মহত্যা পর্যন্ত— বিনোদবিহারী । হা— এই হলে জীবনটার একটুখানি স্বাদ পাওয়া যায়। ভাই, ঐ কালো চোখ, টুকটুকে ঠোঁট, মিষ্টিমুখের সঙ্গে মাঝে মাঝে মিশল না হলে এই রোজ রোজ নিরিমিষ দিনগুলো আর তো মুখে রোচে না । কেবল এই শুকনো বইয়ের বোঝা টেনে এই পচিশটা বৎসর কী করে কাটল বলো দেখি । চন্দ্ৰকান্ত। এর চেয়ে সাধের মানবজন্ম একেবারেই ঘুচিয়ে দিয়ে যদি কোনো গতিকে একটা ইংরেজ নভেলিস্টের মাথার মধ্যে সোধোতে পারা যেত, বেশ দিব্যি সোনার জলে বাধানো একখানি তকতকে বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়ে বেরোত্ম— কখনো ঈডিথ, কখনো এলেন, কখনো লিওনোরার সঙ্গে বেশ ভালো ইংৱিজিতে প্ৰেমালাপ করছি— মেয়ের বাপ বিয়ে দিতে চাচ্ছে না, মেয়ে সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে মরতে চাচ্ছে, শেষকালে নভেলের শেষ পাতায় বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে দুটিতে মিলে ঘরকরনা করছি- হুহু করে এডিশনের পর এডিশন উঠে যাচ্ছে আর পাচি-পাচ শিলিঙে বিক্রি হচ্ছি। বিনোদবিহারী। চমৎকার! কত মেরি-ফ্যানি-লুসির হাতে হাতে কোলে কোলে দিনপাত করা যাচ্ছে। যে-সব নীল চোখ কোনো জন্মে আমাদের প্রতি কটাক্ষপাতও করত না তারা হুহু শব্দে আমাদের জন্য অশ্রুবর্ষণ করছে। তা না হয়ে জন্মালুম বাঙালির ঘরে— কেবল একুইটি আর এভিডেন্স অ্যাক্ট মুখস্থ করে করেই দুর্লভ জীবনটা কাটালুম। নলিনাক্ষ । চললুম ভাই বিনোদ । আমি থাকলে তোমার ভালো লাগে না, তোমাদের গল্প জমে না- চন্দর ছাড়া আর কারও সঙ্গে তোমার প্রাণের কথা হয় না।–“ভালোবাসা ভুলে যাব, মনেরে বুঝাইব, পৃথিবীতে আর যেন কেউ কারেও ভালোবাসে না !” [ দ্রুত প্ৰস্থান বিনোদবিহারী । এই দেখো রোম্যান্সের কথা হচ্ছিল, এই এক রোম্যান্স ! পোড়া অদৃষ্ট এমনি, ভালোবাসা বল যা বল সবই জুটল, কেবল বিধির বিপাকে একটু ব্যাকরণের ভুল হয়েই সব মাটি করে দিয়েছে । , চন্দ্ৰকান্ত । কেবল একটা দীর্ঘ ঈ’র জন্যে। নলিনাক্ষ না হয়ে যদি নলিনাক্ষী হত । হায় হায় ! কিন্তু তা হলে এই মিনসে চন্দ্ৰবিন্দুটাকে লোপ করে দেবার জায়গা পেতে না।