পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বিনোদবিহারী। না ভাই, আসল রত্নটুকুর অনুসন্ধান পাওয়া গেছে, এখন চোখ-কান বুজে। সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। আহা, একবার ভেবে দেখো দেখি চন্দ্ৰ, প্রত্যেক দিনটির সঙ্গে সকাল-সন্ধে দুটি-একটি করে তেমন-তেমন মিষ্টি সুর যদি লাগে, তা হলে জীবনের এক-একটা দিন এক-এক পত্ৰ মদের মতো এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেলা যায়। — r চন্দ্ৰকান্ত। এখন বুঝি কেবল মুখ সিটিকে চিরেতা খাচ্ছিস ? বিনোদবিহারী। তা নয় তো কী। তুমি যে দেখে নিতে বলছি, দেখব কাকে। মানুষ কি চোখ চাইলেই দেখা যায়। দৈবাৎ হাতে ঠেকে । তুমিও যেমন! রাখো জীবনটা বাজি— চক্ষু বুজে দান তুলে নাও, তার পর হয় রাজা নয়। ফকির- একেই তো বলে খেলা । চন্দ্ৰকান্ত । উঃ! কী সাহস ! তোমার কথা শুনলে আমার মতো মরচে-পড়া বিবাহিত লোকেরও বুক সাত হাত হয়ে ওঠে— ফের আর-একটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করে। সত্যি, তোমাদের দেখে হিংসে হয়। একেবারে আঠারো-আনা কবিত্ব করে নিলে হে! না দেখে বিয়ে তো আমরাও করেছি। কিন্তু তার মধ্যে এমনতরো নেশা ছিল না। এ যে একেবারে দেখতে-না-দেখতে এক মুহুর্তে ভো হয়ে উঠল ! নিমাই। তা বলি, বিয়ে যদি করতে হয় নিজে না দেখে করাই ভালো। যেমন ডাক্তারের পক্ষে নিজের কিংবা আত্মীয়ের চিকিৎসে করাটা কিছু নয়। কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের দেখে শুনে নেওয়া উচিত। মেয়েটি কে বলে তো হে চন্দারদা ! চন্দ্ৰকান্ত। আমাদের নিবারণবাবুর বাড়িতে থাকেন, নাম কমলমুখী। আদিত্যবাবু আর নিবারণবাবু পরমবন্ধু ছিলেন। আদিত্য মরবার সময় মেয়েটিকে নিবারণবাবুর হাতে সমর্পণ করে দিয়ে গেছেন। নিবারণবাবু লোকটি কিছু নতুন ধরনের। যেমন কঁচাপাকা মাথা, তেমনি কঁচাপাকা স্বভাবের মানুষটিও। অনেক বিষয়ে সেকেলে অথচ অনেকগুলো একেলে ভাবও আছে। মেয়েটির বয়স হয়েছে, শুনেছি লেখাপড়াও কিছু অতিরিক্ত রকম শেখানো হয়েছে। বিনু যখন মুখনাড়া খাবেন তার মধ্যে ব্যাকরণের ভুল বের করতে পারবেন না। মনে করো, আমার গৃহিণী যখন উক্ত কার্যে প্রবৃত্ত হন তখন প্রায়ই র্তার দুটাে-চারটে গ্রাম্যতা-দোষ সংশোধন করে দিতে হয়, কিন্তু— নিমাই। যাই হােক, একবার দেখে আসতে হচ্ছে। বিনোদবিহারী । খেপেছ নিমাই ! সে তো আর কচি মেয়ে নয় যে, কটি দাত উঠেছে গুনতে যাবে কিংবা বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষা নেবে। নিমাই ! তা বটে, গিয়ে নিজেই অপ্ৰতিভ হয়ে বসে থাকতে হবে, ভয় হবে পাছে আমাকেই একজামিন করে বসে। বিনোদবিহারী । আচ্ছা, একটা বাজি রাখা যাক। কী রকম তাকে দেখতে । গান শুনে আমার মনে একটা চেহারা উঠেছে— রঙ গৌরবর্ণ, পাতলা শরীর, চোখ দুটি খুব চঞ্চল, উজ্জ্বল হাসি এবং কথা মুখে বাধে না। চুল খুব যে বড়ো তা নয়। কিন্তু কুঁকড়ে কুঁকড়ে মুখের চার দিকে পড়েছে! নিমাই। আচ্ছা, আমি বলছি সে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, দোহারা আকৃতি, বেশ ধীর সুগভীর ভাব, বড়ো বড়ো স্থির চক্ষু, বেশি কথা কইতে ভালোবাসে না, প্রশান্তভাবে ঘরকন্নার কাজ করে- খুব দীর্ঘ ঘন। চুল পিঠ আচ্ছন্ন করে পড়েছে। চন্দ্ৰকান্ত। আচ্ছা, আমি বলব ? রঙটি দুধে-আলতায় ; সর্বদা প্ৰফুল্ল ; অন্যের ঠাট্টায় খুব হাসে কিন্তু নিজে ঠাট্টা করতে পারে না ; সরল অথচ বুদ্ধির অভাব নেই। — একটু সামান্য আঘাতে মুখখানি স্নান হয়ে আসে— যেমন অল্প উচ্ছাসেই গান গেয়ে ওঠে তেমনি অল্প বাধাতেই গান বন্ধ হয়ে যায়- ঠিক যাকে চঞ্চল বলে তা নয়। কিন্তু বেশ একটি যেন হিল্লোল আছে। নিমাই। তুমি তোমার প্রতিবেশিনীকে আগে থাকতেই দেখ নি তো ? চন্দ্ৰকান্ত। মাইরি বলছি না। আমার কি আর আশেপাশে দেখবার জো আছে। আমার এ দুটি চক্ষুই একেবারে দস্তখতি-সীলমোহর করা, অন হার ম্যাজেস্টিস সর্ভিস ! তবে শুনেছি বটে দেখতে