পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোড়ায় গলদ ܘ ܘ ܐܓ নলিনাক্ষ। চন্দ্ৰবাবুর সঙ্গে কিন্তু আমার মতের একটুও মিল হচ্ছে না। ভালোবাসা কখনো জোর করে হয় না। একটা গান আছে ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসি নে । আমার স্বভাব এই তোমা বৈ আর জানি নে । আমি কিন্তু বিনু, সম্পূৰ্ণ তোমার দিকে। বিনোদবিহারী। নলিন, একটু থাম তুই— এই বড়ো দুঃখের সময় আর হাসাস নে। চন্দরদী, কী জানি ভাই, একাদিক্ৰমে পচিশ বৎসরকাল বিয়ে না করে বিয়ে না করাটাই যেন একেবারে মুখস্থ হয়ে গেছে। এখন হঠাৎ এই বিয়েটা কিছুতেই মনের মধ্যে গ্রহণ করতে পারছি নে। চন্দ্ৰকান্ত। তোর পায়ে পড়ি বিনু, তুই আমার গা ছুয়ে বল, নিদেন আমার খাতিরে তোর স্ত্রীকে ভালোবাসবি। মনে কর, তুই আমার বোনকে বিয়ে করেছিস । নলিনাক্ষ। চন্দ্ৰবাবুর এ নিতান্ত অন্যায় কথা ! বিনুর প্রতি উনি— বিনোদবিহারী। তুই আর জ্বালাস নে নলিন। বুঝেছি চন্দরদী, যা কিছু মনে করবার তা করেছি— তাকে আমি চোখ বুজে পরী অন্সরী রম্ভা তিলোত্তমা বলে কল্পনা করি কিন্তু তাতে ফল পাই নে। তবে সত্যি কথা বলি চন্দর, আসলে হয়েছে কী, আজকাল টাকার বড়ো টানাটানি— বই থেকে কিছু পাই নে, দেশে যা বিষয় আছে মামাতো ভাইরা লুঠ করে খেলে— নিজে পাড়াগায়ে পড়ে থেকে বিষয় দেখা, সে মরে গেলেও পারব না- ওকালতি ব্যাবসা সবে ধরেছি, ঘর থেকে কেবল গাড়ি-ভাড়াই দিচ্ছি। একলা যখন থাকতুম, আমার কোণের ঘরের ভাঙা চৌকিটিতে এসে বসতুম, আপনাকে রাজা মনে হত। এখন নড়তে-চড়তে কেবল মনে হয় আমার এই ভাঙা ঘর ছেড়া বিছানাটুকুও বেদখল হয়ে গেছে- আমাকে আর-কোথাও ভালো করে ধরে না। নিমাই, তুমি শুনে রাগ করছ, কিন্তু একটু বুঝে দেখো, একটা জুতোর মধ্যে দুটাে পা ঢোকে না, তা দুই পায়ে যতই প্ৰণয় থাক । নলিনাক্ষ। বিনু যা বলছে। ওর সমস্ত কথাই আমি মানি। নিমাই। তা হলে তোমার ভালোবাসার অভাব নেই, কেবল টাকার অভাব। বিনোদবিহারী। কথাটা যে প্ৰায় একই দাড়ায়নিমাই। কী বল! কথাটা একই! ভালোবাসাকে তুমি একেবারে উড়িয়ে দিতে চাও— বিনোদবিহারী। না ভাই, আমি ভালোবাসাটাকে স্নায়ুর ব্যামো কিংবা মিথ্যে বলছি নে ; আমি বলছি ও জিনিসটা কিছু শৌখিন জাতের। ওর বিস্তর আসবাবের দরকার। টানাটানির বাজারে ওকে নিয়ে বড়ো বিব্রত হয়ে পড়তে হয়। আমি বেশ বুঝতে পারি, চতুর্দিকটি বেশ মনের মতো হত, ট্রামের ঘড়ঘড় না থাকত, দাসীমাগী ঝগড়া না করত, গয়লা ঠিক নিয়মিত দুধ জোগাত এবং দাম না চাইত, মাসান্তে বাড়িওয়ালা একবার করে অপমান করে না যেত, জজসাহেব বিচারাসনে বসে আমার ইংরিজি ভুল সংশোধন করে না দিত, তা হলে আমিও ক্রমে ক্ৰমে ভালোবাসতে পারতুম— কিন্তু এখন। সংগীত, চাদের আলো, প্ৰেমালাপ, এ কিছুই রুচিছে না— আমার পটলডাঙার সেই বাসার মধ্যে এ-সমস্ত শৌখিন জিনিস পুষতে পারছি নে। চন্দ্ৰকান্ত। ভালোবাসা যে এতবড়ো ফুলবাবু তা জানতুম না— কী করেই বা জানিব, ওঁর সঙ্গে আমার কখনোই পরিচয় নেই। নিমাই। ছিছি। বিনোদ, তোমার এতদিনকার কবিত্ব শেষকালে পয়সার থলির মধ্যে গুজলে হে! বিনােদবিহারী। নিমাই, তুমি এমন কথাটা বললে! আমি দুৰ্গন্ধ পয়সার কাঙাল! ছেঃ! অভাবকে কি আমি অভাব বলে ডরাই— তা নয়, কিন্তু তার চেহারাটা অতি বিশ্ৰী, জীৰ্ণশীর্ণ, মলিন, কুৎসিত, কদাকার, হাড়-বের-করা ; নিতান্ত গায়ের কাছে তাকে সর্বদা সহ্য হয় না। তার ময়লা হাতে সে পৃথিবীর যা-কিছু ছোয় তাই দাগি হয়ে যায়, তা চাদের আলোই বল, আর প্ৰেয়সীর হাসিই বল। এতদিন আমার টাকা ছিল না, অভাবও ছিল না— বিয়ের পর থেকে দারিদ্র্য বলে একটা কদৰ্য