পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি VbrS সাশ্রনেত্ৰে কহিলেন, “তোমার সঙ্গেই তো সব ঠিক হইয়াছিল, আবার কেন উলটাইয়া দিলে। আবার তোমাকেই মত দিতে হইবে। তুমি উদ্ধার না করিলে আমাকে বড়ো লজ্জায় পড়িতে হইবে। মেয়েটি বড়ো লক্ষ্মী, তোমার অযোগ্য হইবে না।” বিহারী কহিল, “কাকীমা, সে কথা আমাকে বলা বাহুল্য। তোমার বোনঝি যখন, তখন আমার অমতের কোনো কথাই নাই। কিন্তু মহেন্দ্ৰ-” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “না বাছা, মহেন্দ্রের সঙ্গে তাহার কোনোমতেই বিবাহ হইবার নয়। আমি তোমাকে সত্য কথাই বলিতেছি, তোমার সঙ্গে বিবাহ হইলেই আমি সব চেয়ে নিশ্চিন্ত হই। মহিনের সঙ্গে সম্বন্ধে আমার মত নাই।” বিহারী কহিল, “কাকী, তোমার যদি মত না থাকে, তাহা হইলে কোনো কথাই নাই।” এই বলিয়া সে রাজলক্ষ্মীর নিকটে গিয়া কহিল, “মা, কাকীর বোনঝির সঙ্গে আমার বিবাহ স্থির হইয়া গেছে, আত্মীয় স্ত্রীলোক কেহ কাছে নাই- কাজেই লজ্জার মাথা খাইয়া নিজেই খবরটা দিতে হইল।” রাজলক্ষ্মী। বলিস কী বিহারী। বড়ো খুশি হইলাম। মেয়েটি লক্ষ্মী মেয়ে, তোর উপযুক্ত। এ মেয়ে কিছুতেই হাতছাড়া করিস নে। বিহারী। হাতছাড়া কেন হইবে । মহিনদা নিজে পছন্দ করিয়া আমার সঙ্গে সম্বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। এই-সকল বাধাবিদ্মে মহেন্দ্ৰ দ্বিগুণ উত্তেজিত হইয়া উঠিল। সে মা ও কাকীর উপর রাগ করিয়া একটা দীনহীন ছাত্রাবাসে গিয়া আশ্রয় লইল । রাজলক্ষ্মী কাদিয়া অন্নপূর্ণার ঘরে উপস্থিত হইলেন; কহিলেন, “মেজোবউ, আমার ছেলে বুঝি উদাস হইয়া ঘর ছাডিল, তাহাকে রক্ষা করো।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “দিদি, একটু ধৈর্য ধরিয়া থাকো, দুদিন বাদেই তাহার রাগ পড়িয়া যাইবে।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুমি তাহাকে জান না। সে যাহা চায়, না পাইলে যাহা-খুশি করিতে পারে। অন্নপূর্ণা। দিদি, সে কী করিয়া হয়- বিহারীর সঙ্গে কথাবার্তা একপ্রকার পাকা হইয়াছে। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে ভাঙিতে কতক্ষণ।” বলিয়া বিহারীকে ডাকিয়া কহিলেন, “বাবা, তোমার জন্য ভালো পাত্রী দেখিয়া দিতেছি, এই কন্যাটি ছাড়িয়া দিতে হইবে, এ তোমার যোগ্যই নয়।” বিহারী কহিল, “না মা, সে হয় না। সে-সমস্তই ঠিক হইয়া গেছে।” তখন রাজলক্ষ্মী অন্নপূর্ণাকে গিয়া কহিলেন, “আমার মাথা খাও মেজেবিউ, তোমার পায়ে ধরি, তুমি বিহারীকে বলিলেই সব ঠিক হইবে।” অন্নপূর্ণ বিহারীকে কহিলেন, “বিহারী, তোমাকে বলিতে আমার মুখ সরিতেছে না, কিন্তু কী করি বলো। আশা তোমার হাতে পড়িলেই আমি বড়ো নিশ্চিন্ত হইতাম, কিন্তু সব তো জানিতেছই—” বিহারী। বুঝিয়াছি কাকী। তুমি যেমন আদেশ করিবে তাঁহাই হইবে। কিন্তু আমাকে আর কখনো কাহারও সঙ্গে বিবাহের জন্য অনুরোধ করিয়ো না। বলিয়া বিহারী চলিয়া গেল। অন্নপূর্ণর চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল, মহেন্দ্রের অকল্যাণ-আশঙ্কায় মুছিয়া ফেলিলেন। বার বার মনকে বুঝাইলেন— যাহা হইল, তাহা ভালেই হইল। এইরূপে রাজলক্ষ্মী অন্নপূর্ণ এবং মহেন্দ্রের মধ্যে নিষ্ঠুর নিগৃঢ় নীরব ঘাত-প্ৰতিঘাত চলিতে চলিতে বিবাহের দিন সমাগত হইল। বাতি উজ্জ্বল হইয়া জ্বলিল, সানাই মধুর হইয়া বাজিল, মিষ্টান্নে মিষ্টেব্য ভাগ লেশমাত্র কম পড়িল না। আশা সজ্জিতসুন্দরদেহে লজ্জিতমুগ্ধমুখে আপনি নূতন সংসারে প্রথম পদার্পণ করিল ; তাহার এই কুলায়ের মধ্যে কোথাও যে কোনো কণ্টক আছে, তাহা তাহার কম্পিত-কোমল হৃদয় অনুভব করিল না; বরঞ্চ জগতে তাহার একমাত্র মাতৃস্থানীয়া অন্নপূর্ণার কাছে আসিতেছে বলিয়া আশ্বাসে ও আনন্দে তাহার সর্বপ্রকার ভয় সংশয় দূর হইয়া গেল।