পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি Votro সে যতই জ্ঞানলাভের চেষ্টা করে, অক্ষরগুলো ততই তাহার দৃষ্টিপথের উপর দিয়া কালো পিপীলিকার মতো সার বাধিয়া চলিয়া যায়। পরীক্ষকের ডাক শুনিয়া অপরাধীর মতো আশা ভয়ে ভয়ে বইখানি লইয়া মহেন্দ্রের চৌকির পাশে আসিয়া উপস্থিত হয়। মহেন্দ্ৰ এক হাতে কটিদেশ বেষ্টনপূর্বক তাহাকে দৃঢ়রাপে বন্দী করিয়া অপর হাতে বই ধরিয়া কহে, “আজি কতটা পড়িলে দেখি।” আশা যতগুলা লাইনে চোখ বুলাইয়াছিল, দেখাইয়া দেয়। মহেন্দ্ৰ ক্ষুঃস্বরে বলে, “উঃ! এতটা পড়িতে পারিয়াছ ? আমি কতটা পড়িয়াছি দেখিবে ?” বলিয়া তাহার ডাক্তারি বইয়ের কোনো-একটা অধ্যায়ের শিরোনামটুকু মাত্র দেখাইয়া দেয়। আশা বিস্ময়ে চোখদুটা ডাগর করিয়া বলে, “তবে এতক্ষণ কী করিতেছিলে।” মহেন্দ্ৰ তাহার চিবুক ধরিয়া বলে, “আমি একজনের কথা ভাবিতেছিলাম, কিন্তু যাহার কথা ভাবিতেছিলাম সেই নিষ্ঠুর তখন চারুপাঠে উইপোকার অত্যন্ত মনোহর বিবরণ লইয়া ভুলিয়া ছিল।” আশা এই অমূলক অভিযোগের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দিতে পারিতি- কিন্তু হায়, কেবলমাত্র লজ্জার খাতিরে প্রেমের ইহা হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হইবে, মহেন্দ্রের এই পাঠশালাটি সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিদ্যালয়ের কোনো নিয়ম মানিয়া চলে না। r হয়তো একদিন মহেন্দ্ৰ উপস্থিত নাই- সেই সুযোগে আশা পাঠে মন দিবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় কোথা হইতে মহেন্দ্ৰ আসিয়া তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল, পরে তাহার বই কড়িয়া লইল, কহিল, “নিষ্ঠুর, আমি না থাকিলে তুমি আমার কথা ভাব না, পড়া লইয়া থাক ?” আশা কহিল, “তুমি আমাকে মুখ করিয়া রাখিবে ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তোমার কল্যাণে আমারই বা বিদ্যা এমনই কী অগ্রসর হইতেছে।” কথাটা আশাকে হঠাৎ বাজিল ; তৎক্ষণাৎ চলিয়া যাইবার উপক্রম করিয়া কহিল, “আমি তোমার পড়ায় কী বাধা দিয়াছি।” মহেন্দ্ৰ তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “তুমি তাহার কী বুঝিবে। আমাকে ছাড়িয়া তুমি যত সহজে পড়া করিতে পাের, তোমাকে ছাডিয়া তত সহজে আমি আমার পড়া করিতে পারি না।” গুরুতর দোষারোপ। ইহার পরে স্বভাবতই শরতের এক পাসলার মতো এক দফা কান্নার সৃষ্টি হয় এবং অনতিকালমধ্যেই কেবল একটি সজল উজ্জ্বলতা রাখিয়া সোহাগের সূর্যালোকে তাহা বিলীন হইয়া যায়। শিক্ষক যদি শিক্ষার সর্বপ্ৰধান অন্তরায় হন, তবে অবলা ছাত্রীর সাধ্য কী বিদ্যারণ্যের মধ্যে পথ করিয়া চলে। মাঝে মাঝে মাসিমার তীব্র ভৎসনা মনে পড়িয়া চিত্ত বিচলিত হয়— বুঝিতে পারে, লেখাপড়া একটা ছুতা মাত্ৰ : শাশুড়িকে দেখিলে লজ্জায় মরিয়া যায়। কিন্তু শাশুড়ি তাহাকে কোনো । কাজ করিতে বলেন না, কোনো উপদেশ দেন না ; অনাদিষ্ট হইয়া আশা শাশুড়ির গৃহকার্যে সাহায্য করিতে গেলে তিনি ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলেন, “কর কী, কর কী, শোবার ঘরে যাও, তোমার পড়া কামাই যাইতেছে।” অবশেষে অন্নপূর্ণ। আশাকে কহিলেন, “তোর যা শিক্ষা হইতেছে সে তো দেখিতেছি, এখন মহিনীকেও কি ডাক্তগরি দিতে দিবি না।” শুনিয়া আশা মনকে খুব শক্ত করিল, মহেন্দ্ৰকে বলিল, “তোমার একজামিনের পড়া হইতেছে না, আজ হইতে আমি নীচে মাসিমার ঘরে গিয়া থাকিব ।” এ বয়সে এতবড়ো কঠিন সন্ন্যাসব্রত ! শয়নালয় হইতে একেবারে মাসিমার ঘরে আত্মনির্বাসন ! এই কঠোর প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করিতে তাহার চোখের প্রান্তে জল আসিয়া পড়িল, তাহার অবাধ্য ক্ষুদ্র অধর কঁপিয়া উঠিল এবং কণ্ঠস্বর রুদ্ধপ্ৰায় হইয়া আসিল । মহেন্দ্ৰ কহিল, “তবে তাই চলো, কাকীর ঘরেই যাওয়া যাক— কিন্তু তাহা হইলে তাহাকে উপরে રે || ર 6