পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○b-bア রবীন্দ্র-রচনাবলী ‘অন্নপূর্ণার গৃহত্যাগে এবং আমার গৃহত্যাগে প্ৰভেদ আছে- সে হইল মন্ত্র-জানা ডাইনী আর আমি হইলাম শুদ্ধমাত্র মা, আমার যাওয়াই ভালো ।” অন্নপূর্ণ ভিতরকার কথাটা বুঝিলেন, তিনি মহেন্দ্ৰকে বলিলেন, “দিদি গেলে আমিও থাকিতে পারিব না ।” মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীকে কহিল, “শুনিতেছ। মা ? তুমি গেলে কাকীও যাইবেন, তাহা হইলে আমাদের ঘরের কাজ চলিবে কী করিয়া।” রাজলক্ষ্মী বিদ্বেষবিষে জর্জরিত হইয়া কহিলেন, “তুমি যাইবে মেজোবউ ? এও কি কখনো হয়। তুমি গেলে চলিবে কী করিয়া। তোমার থাকা চাই-ই।” রাজলক্ষ্মীর আর বিলম্ব সহিল না। পরদিন মধ্যাহ্নেই তিনি দেশে যাইবার জন্য প্ৰস্তুত। মহেন্দ্ৰই যে তাহাকে দেশে রাখিয়া আসিবে, এ বিষয়ে বিহারীর বা আর-কাহারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সময়কালে দেখা গেল, মহেন্দ্ৰ মারি সঙ্গে একজন সরকার ও দরোয়ান পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছে। বিহারী কহিল, “মহিনদা, তুমি যে এখনো তৈরি হও নাই ?” বিহারী কহিল, “আচ্ছা তুমি থাকো, মাকে আমি পৌছাইয়া দিয়া আসিব ।” ও দেখাইতে চায়, যেন ও আমার চেয়ে মার কথা বেশি ভাবে ।” অন্নপূর্ণাকে থাকিতে হইল, কিন্তু তিনি লজ্জায় ক্ষোভে ও বিরক্তিতে সংকুচিত হইয়া রহিলেন। খুড়ীর এইরূপ দূরভাব দেখিয়া মহেন্দ্র রাগ করিল এবং আশাও অভিমান করিয়া রহিল। Գ রাজলক্ষ্মী জন্মভূমিতে পৌছিলেন। বিহারী তাহাকে পৌছাইয়া চলিয়া আসিবে এরূপ কথা ছিল ; কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখিয়া, সে ফিরিল না। রাজলক্ষ্মীর পৈতৃক বাটীতে দুই-একটি অতিবৃদ্ধ বিধবা র্বাচিয়া ছিলেন মাত্র। চারি দিকে ঘন জঙ্গল ও বাশবন, পুষ্করিণীর জল সবুজবর্ণ, দিনে-দুপুরে শেয়ালের ডাকে রাজলক্ষ্মীর চিত্ত উদভ্ৰান্ত श्ङ्ग्रेशा ऐछे८छ । বিহারী কহিল, “মা, জন্মভূমি বটে, কিন্তু ‘স্বৰ্গাদপি গরীয়সী’ কোনোমতেই বলিতে পারি না। কলিকাতায় চলো। এখানে তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া গেলে আমার অধৰ্ম হইবে।” রাজলক্ষ্মীরও প্ৰাণ হাপাইয়া উঠিয়াছিল। এমন সময় বিনোদিনী আসিয়া তাহাকে আশ্রয় দিল এবং আশ্রয়- করিল। বিনোদিনীর পরিচয় প্ৰথমেই দেওয়া হইয়াছে। এক সময়ে মহেন্দ্র এবং তদভাবে বিহারীর সহিত তাহার বিবাহের প্রস্তাব হইয়াছিল। বিধিনির্বন্ধে যাহার সহিত তাহার শুভবিবাহ হয়, সে লোকটির সমস্ত অন্তরিান্দ্ৰিয়ের মধ্যে প্লীহাই ছিল সর্বাপেক্ষা প্ৰবল। সেই প্লীহার অতিভারেই সে দীর্ঘকাল জীবনধারণা করিতে পারিল না। তাহার মৃত্যুর পর হইতে বিনোদিনী, জঙ্গলের মধ্যে একটিমাত্র উদ্যােনলতার মতো, নিরানন্দ পল্লীর মধ্যে মুহ্যমান ভাবে জীবনযাপন করিতেছিল। অদ্য সেই অনাথ আসিয়া তাহার রাজলক্ষ্মী পিসশাশঠাকরুনকে ভক্তিভরে প্রণাম করিল এবং তাহার সেবায় আত্মসমৰ্পণ করিয়া দিল। সেবা ইহাকেই বলে। মুহুর্তের জন্য আলস্য নাই। কেমন পরিপাটি কাজ, কেমন সুন্দর রান্না, কেমন সুমিষ্ট কথাবার্তা। রাজলক্ষ্মী বলেন, “বেলা হইল মা, তুমি দুটি খাও গে যাও।” সে কি শোনে ? পাখা করিয়া পিসিমাকে ঘুম না পাড়াইয়া সে উঠে না।