পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ここ ○ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী করিলেন। কহিলেন, “আহা, বউ লইয়া মহিন সুখে আছে, সুখে থাক— যেমন করিয়া হােক সে সুখী হােক | বউকে লইয়া আমি তাহাকে আর কোনো কষ্ট দিব না । আহা, যে মা কখনো তাহাকে এক দণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারে না সেই মা চলিয়া আসিয়াছে বলিয়া মহিন মারি পরে রাগ করিয়াছে!’ বার বার তার চোখ দিয়া জল উছলিয়া উঠিতে লাগিল । সেদিন রাজলক্ষ্মী বিহারীকে বার বার আসিয়া বলিলেন, “যাও বাবা, তুমি স্নান করো গে যাও । এখানে তোমার বড়ো অনিয়ম হইতেছে।” বিহারীরও সেদিন স্নানাহারে যেন প্ৰবৃত্তি ছিল না ; সে কহিল, “মা, আমার মতো লক্ষ্মীছাড়ারা অনিয়মেই ভালো থাকে।” রাজলক্ষ্মী পীড়াপীড়ি করিয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি স্নান করিতে যাও।” বিহারী সহস্ৰ বার অনুরুদ্ধ হইয়া নাহিতে গেল। সে ঘরের বাহির হইবামাত্রই রাজলক্ষ্মী বহির ভিতর হইতে তাড়াতাড়ি সেই কুঞ্চিতদলিত চিঠিখানি বাহির করিয়া লইলেন। বিনোদিনীর হাতে চিঠি দিয়া কহিলেন, “দেখো তো মা, মহিন বিহারীকে কী লিখিয়াছে।” বিনোদিনী পড়িয়া শুনাইতে লাগিল। মহেন্দ্ৰ প্ৰথমটা মার কথা লিখিয়াছে ; কিন্তু সে অতি অল্পই। বিহারী যতটুকু শুনাইয়াছিল তাহার অধিক নহে। তার পরেই আশার কথা। মহেন্দ্র রঙ্গে রহস্যে আনন্দে যেন মাতাল হইয়া লিখিয়াছে। শুনিবে ।” রাজলক্ষ্মীর মেহব্যগ্র মুখের ভাব এক মুহূর্তের মধ্যেই পাথরের মতো শক্ত হইয়া যেন জমিয়া গেল। রাজলক্ষ্মী একটুখানি চুপ করিয়া রহিলেন, তার পরে বলিলেন, “থাক।” বলিয়া চিঠি ফেরত না লইয়াই চলিয়া গেলেন । বিনোদিনী সেই চিঠিখানা লইয়া ঘরে ঢুকিল। ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িতে লাগিল। চিঠির মধ্যে বিনোদিনী কী রস পাইল, তাহা বিনোদিনীই জানে। কিন্তু তাহা কৌতুকরস নহে! বার বার করিয়া পড়িতে পড়িতে তাহার দুই চক্ষু মধ্যাহ্নের বালুকার মতো জ্বলিতে লাগিল, তাহার নিশ্বাস মরুভূমির বাতাসের মতো উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। মহেন্দ্ৰ কেমন, আশা কেমন, মহেন্দ্ৰ-আশার প্রণয় কেমন, ইহাই তাহার মনের মধ্যে কেবলই পাক খাইতে লাগিল। চিঠিখানা কোলের উপর চাপিয়া ধরিয়া পা ছড়াইয়া দেয়ালের উপর হেলান দিয়া অনেকক্ষণ সম্মুখে চাহিয়া বসিয়া রহিল। মহেন্দ্রের সে চিঠি বিহারী আর খুঁজিয়া পাইল না। সেইদিন মধ্যাহ্নে হঠাৎ অন্নপূর্ণ আসিয়া উপস্থিত। দুঃসংবাদের আশঙ্কা করিয়া রাজলক্ষ্মীর বুকটা হঠাৎ কঁাপিয়া উঠিল— কোনো প্রশ্ন করিতে তিনি সাহস করিলেন না, অন্নপূণার দিকে পাংশুবৰ্ণ মুখে চাহিয়া রহিলেন । অন্নপূর্ণ কহিলেন, “দিদি, কলিকাতার খবর সব ভালো।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তবে তুমি এখানে যে ?” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “দিদি, তোমার ঘরকন্নার ভার তুমি লও’সে। আমার আর সংসারে মন নাই। আমি কাশী যাইব বলিয়া যাত্ৰা করিয়া বাহির হইয়াছি। তাই তোমাকে প্ৰণাম করিতে আসিলাম । জ্ঞানে অজ্ঞানে অনেক অপরাধ করিয়াছি, মাপ করিয়ো । আর তোমার বউ, ( বলিতে বলিতে চোখ ভরিয়া উঠিয়া জল পড়িতে লাগিল।) সে ছেলেমানুষ, তার মা নাই, সে দোষী হােক নির্দোষ হােক সে তোমার।” আর বলিতে পারিলেন না । রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া তাহার স্নানাহারের ব্যবস্থা করিতে গেলেন। বিহারী খবর পাইয়া গদাই ঘোষের চণ্ডীমণ্ডপ হইতে ছুটিয়া আসিল। অন্নপূর্ণাকে প্ৰণাম করিয়া কহিল, “কাকিম, সে কি হয় ?