পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VDS NR রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহা তাহার কিছুমাত্র জানা ছিল না— কতকগুলা বোঝা লইয়া আনন্দে ঘরে ফিরিয়া আসিল। সেগুলা লইয়া যে কী করিতে হইবে, আশাও তাহা ভালোরূপ জানে না। পরীক্ষায় বেলা দুটা-তিনটা হইয়া গেল এবং নানাবিধ অভূতপূর্ব অখাদ্য উদভাবন করিয়া মহেন্দ্ৰ অত্যন্ত আমোদ বোধ করিল। আশা মহেন্দ্রের আমোদে যোগ দিতে পারিল না, আপনি অজ্ঞতা ও অক্ষমতায় মনে মনে অত্যন্ত লজ্জা ও ক্ষোভ পাইল । ঘরে ঘরে জিনিসপত্রের এমনি বিশৃঙ্খলা ঘটিয়াছে যে, আবশ্যকের সময়ে কোনো জিনিস খুঁজিয়া পাওয়াই কঠিন। মহেন্দ্রের চিকিৎসার অস্ত্র একদিন তরকারি কুটিবার কার্যে নিযুক্ত হইয়া আবর্জনার মধ্যে অজ্ঞাতবাস গ্ৰহণ করিল এবং তাহার নোটের খাতা হাতপাখার অ্যাকটিনি করিয়া রান্নাঘরের ভস্মশয্যায় বিশ্রাম করিতে লাগিল । এই সকল অভাবনীয় ব্যবস্থাবিপর্যয়ে মহেন্দ্রের কৌতুকের সীমা রহিল না, কিন্তু আশা ব্যথিত হইতে থাকিল। উচ্ছঙ্খল যথেচ্ছাচারের স্রোতে সমস্ত ঘরকন্না ভাসাইয়া হাস্যমুখে ভাসিয়া চলা বালিকার কাছে বিভীষিকাজনক বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । একদিন সন্ধ্যার সময় দুইজনে ঢাকা-বারান্দায় বিছানা করিয়া বসিয়াছে। সম্মুখে খোলা ছাদ। বৃষ্টির পরে কলিকাতার দিগন্তব্যাপী সৌধশিখরশ্রেণী জ্যোৎস্নায় প্লাবিত। বাগান হইতে রাশীকৃত ভিজা বকুল সংগ্ৰহ করিয়া আশা নতশিরে মালা গাঁথিতেছে। মহেন্দ্ৰ তাহা লইয়া টানাটানি করিয়া, বাধা ঘটাইয়া, প্রতিকূল সমালোচনা করিয়া, অনৰ্থক একটা কলহ সৃষ্টি করিবার উদযোগ করিতেছিল। আশা এই-সকল অকারণ উৎপীড়ন লইয়া তাহাকে ভৎসনা করিবার উপক্ৰম করিবামাত্ৰ মহেন্দ্ৰ কোনো-একটি কৃত্রিম উপায়ে আশার মুখ বন্ধ করিয়া শাসনবাক্য অকুরেই বিনাশ করিতেছিল। এমন সময় প্রতিবেশীর বাড়ির পিঞ্জরের মধ্য হইতে পোষা কোকিল কুহু কুহু করিয়া ডাকিয়া উঠিল। তখনই মহেন্দ্র এবং আশা তাহাদের মাথার উপরে দোদুল্যমান খাচার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। তাহাদের কোকিল প্রতিবেশী কোকিলের কুহুধ্বনি কখনো নীরবে সহ্য করে নাই, আজ সে জবাব দেয় না কেন ? আশা উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিল, “পাখির আজ কী হইল।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তোমার কণ্ঠ শুনিয়া লজাবোধ করিতেছে।” আশা সানুনয়স্বরে কহিল, “না, ঠাট্টা নয়, দেখো-না উহার কী হইয়াছে।” মহেন্দ্র তখন খাচা পাড়িয়া নামাইল। খাচার আবরণ খুলিয়া দেখিল, পাখি মরিয়া গেছে। অন্নপূর্ণার যাওয়ার পর বেহার ছুটি লইয়া গিয়াছিল, পাখিকে কেহ দেখে নাই। দেখিতে দেখিতে আশার মুখ স্নান হইয়া গেল। তাহার আঙুল চলিল না— ফুল পড়িয়া রহিল। মহেন্দ্রের মনে আঘাত লাগিলেও, অকালে রাসভঙ্গের আশঙ্কায় ব্যাপারটা সে হাসিয়া উড়াইবার চেষ্টা করিল। কহিল, “ভালোই হইয়াছে, আমি ডাক্তারি করিতে যাইতাম, আর ওটা কুহুস্বরে তোমাকে క్లా রিত।” এই বলিয়া মহেন্দ্ৰ আশাকে বাহুপাশে বেষ্টন করিয়া কাছে টানিয়া লইবার চেষ্টা व् | আশা আস্তে আস্তে আপনাকে ছাড়াইয়া লইয়া আঁচল শূন্য করিয়া বকুলগুলা ফেলিয়া দিল। কহিল, “আর কেন। ছিঃ ছি। তুমি শীঘ্ৰ যাও, মাকে ফিরাইয়া আনো গে।” s এমন সময় দোতলা হইতে “মহিনদা মহিনদা” রব উঠিল। “আরো কে হে, এসো এসো” বলিয়া মহেন্দ্ৰ জবাব দিল। বিহারীর সাড়া পাইয়া মহেন্দ্রের চিত্ত উৎফুল্প হইয়া উঠিল। বিবাহের পর বিহারী মাঝে মাঝে তাহাদের সুখের বাধাস্বরূপ আসিয়াছে— আজ সেই বাধাই সুখের পক্ষে একান্ত প্ৰয়োজনীয় বলিয়া বোধ হইল।