পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\5) პა 8 Կ রবীন্দ্র-রচনাবলী ভাবিলেন, “মহেন্দ্ৰ মনে করিবে, খুড়ী যখন ছিল, তখন বন্ধুকে লইয়া আমি বেশ নিষ্কণ্টকে সুখে ছিলাম— আর মা আসিতেই আমার বিরহদুঃখ আরম্ভ হইল। ইহাতে অন্নপূর্ণ যে তাহার হিতৈষী এবং মা যে তাহার সুখের অন্তরায়, ইহাই প্রমাণ হইবে। কাজ কী।’ আজকাল দিনের বেলা মহেন্দ্ৰ ডাকিয়া পাঠাইলে বধু যাইতে ইতস্তত করিত— কিন্তু রাজলক্ষ্মী ভৎসনা করিয়া বলিতেন, “মহিন ডাকিতেছে, সে বুঝি আর কানে তুলিতে নাই। বেশি আদর পাইলে শেষকালে এমনই ঘটিয়া থাকে। যাও, তোমার আর তরকারিতে হাত দিতে হইবে না।” আবার সেই ফ্লেট-পেনসিল চারুপাঠ লইয়া মিথ্যা খেলা। ভালোবাসার অমূলক অভিযোগ লইয়া পরস্পরকে অপরাধী করা। উভয়ের মধ্যে কাহার প্রেমের ওজন বেশি, তাহা লইয়া বিনা-যুক্তিমূলে তুমুল তর্কবিতর্ক। বর্ষার দিনকে রাত্রি করা এবং জ্যোৎস্নারাত্রিকে দিন করিয়া তোলা। শ্ৰান্তি এবং অবসাদকে গায়ের জোরে দূর করিয়া দেওয়া। পরস্পরকে এমনি করিয়া অভ্যাস করা যে, সঙ্গ যখন অসাড় চিত্তে আনন্দ দিতেছে না। তখনো ক্ষণকালের জন্য মিলনপাশ হইতে মুক্তি ভয়াবহ মনে হয়— সম্ভোগসুখ ভস্মাচ্ছন্ন, অথচ কর্মান্তরে যাইতেও পা ওঠে না। ভোগসুখের এই ভয়ংকর অভিশাপ যে, সুখ অধিক দিন থাকে না, কিন্তু বন্ধন দুশোচ্ছদ্য হইয়া উঠে। এমন সময় বিনোদিনী একদিন আসিয়া আশার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “ভাই, তোমার সৌভাগ্য চিরকাল অক্ষয় হােক, কিন্তু আমি দুঃখিনী বলিয়া কি আমার দিকে একবার তাকাইতে নাই।” আত্মীয় গৃহে বাল্যকাল হইতে পরের মতো লালিত হইয়াছিল বলিয়া লোক-সাধারণের নিকট আশার একপ্রকার আন্তরিক কুষ্ঠিতভাব ছিল। ভয় হইত, পাছে কেহ প্রত্যাখ্যান করে। বিনোদিনী যখন তাহার জোড়া ভুরু ও তীক্ষ দৃষ্টি, তাহার নিখুঁত মুখ ও নিটােল যৌবন লইয়া উপস্থিত হইল, তখন আশা অগ্রসর হইয়া তাহার পরিচয় লইতে সাহস করিল না। আশা দেখিল, শাশুড়ি রাজলক্ষ্মীর নিকট বিনোদিনীর কোনোপ্রকার সংকোচ নাই। রাজলক্ষ্মীও যেন আশাকে বিশেষ করিয়া দেখাইয়া দেখাইয়া বিনোদিনীকে বহুমান দিতেছেন, সময়ে-অসময়ে আশাকে বিশেষ করিয়া শুনাইয়া শুনাইয়া বিনোদিনীর প্রশংসাবাক্যে উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছেন। আশা দেখিল, বিনোদিনী সর্বপ্রকার গৃহকর্মে সুনিপুণ— প্ৰভুত্ব যেন তাহার পক্ষে নিতান্ত সহজ স্বভাবসিদ্ধ- দাসদাসী দিগকে কর্মে নিয়োগ করিতে, ভৎসনা করিতে ও আদেশ করিতে সে লেশমাত্র কুষ্ঠিত নহে। এই-সমস্ত দেখিয়া আশা বিনোদিনীর কাছে নিজেকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে করিল। সেই সর্বগুণশালিনী বিনোদিনী যখন অগ্রসর হইয়া আশার প্রণয় প্রার্থনা করিল, তখন সংকোচের বাধায় ঠেকিয়াই বালিকার আনন্দ আরো চার গুণ উছলিয়া পড়িল। জাদুকরের মায়াতরুর মতো তাহাদের প্রণয়বীজ একদিনেই অঙ্কুরিত পল্লবিত ও পুষ্পিত হইয়া উঠিল। আশা কহিল, “এসো ভাই, তোমার সঙ্গে একটা কিছু পাতাই।” আশা গঙ্গাজল বকুলফুল প্রভৃতি অনেকগুলি ভালো ভালো জিনিসের নাম করিল। বিনোদিনী কহিল, ”ও-সব পুরানো হইয়া গেছে ; আদরের নামের আর আদর নাই ।” বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “চোখের বালি।” শ্রুতিমধুর নামের দিকেই আশার ঝোক ছিল, কিন্তু বিনোদিনীর পরামর্শে আদরের গালিটিই গ্ৰহণ করিল। বিনোদিনীর গলা ধরিয়া বলিল, “চােখের বালি।” বলিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল।