পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি \DSG উহাকে যাবজীবন বনবাসে পাঠানো, সেও বড়ো কঠিন দণ্ড ।” এটুকু বুঝিয়াছে, এ নারী জঙ্গলে ফেলিয়া রাখিবার নহে। কিন্তু শিখা এক ভাবে ঘরের প্রদীপরূপে জ্বলে, আর-এক ভাবে ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়- সে আশঙ্কাও বিহারীর মনে ছিল। মহেন্দ্ৰ বিহারীকে এই কথা লইয়া অনেক পরিহাস করিল। বিহারীও তাহার জবাব দিল। কিন্তু তাহার মন বুঝিয়াছিল, এ নারী খেলা করিবার নহে, ইহাকে উপেক্ষা করাও যায় না। রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে সাবধান করিয়া দিলেন। কহিলেন, “দেখো বাছা, বউকে লইয়া তুমি অত টানাটানি করিয়ো না। তুমি পাড়াগায়ের গৃহস্থ-ঘরে ছিলে— আজিকালিকার চালচলন জান না। তুমি আমার মতো অবস্থার লোক আপন মান বঁাচাইয়া চলিতে না জানিলে, কোন দিন কী ঘটে বলা যায় কি ৷” আশা সাধাসাধি কান্নাকাটি করিয়া মরে- বিনোদিনী দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ। মনের কথায় আশা আকণ্ঠ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু বিনোদিনী আমল দিল না। এ দিকে মহেন্দ্রের বাহুপাশ শিথিল এবং তাহার মুগ্ধদৃষ্টি যেন ক্লাস্তিতে আবৃত হইয়া আসিয়াছে ! পূর্বে যে-সকল অনিয়ম-উচ্ছঙ্খলা তাহার কাছে কৌতুকজনক বোধ হইত, এখন তাহা অল্পে অল্পে তাহাকে পীড়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। আশার সাংসারিক অপটুতায় সে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, কিন্তু প্ৰকাশ করিয়া বলে না | প্ৰকাশ না করিলেও আশা অন্তরে অন্তরে অনুভব করিয়াছে, নিরবচ্ছিন্ন মিলনে প্রেমের মর্যাদা স্নান হইয়া যাইতেছে । মহেন্দ্রের সোহাগের মধ্যে বেসুর লাগিতেছিলকতকটা মিথ্যা বাড়াবাড়ি, কতকটা আত্মপ্রতারণা | এ সময়ে পলায়ন ছাড়া পরিত্রাণ নাই, বিচ্ছেদ ছাড়া ঔষধ নাই। স্ত্রীলোকের স্বভাবসিদ্ধ সংস্কারবশে আশা আজকাল মহেন্দ্ৰকে ফেলিয়া যাইবার চেষ্টা করিত। কিন্তু বিনোদিনী ছাড়া তাহার যাইবার স্থান কোথায় । মহেন্দ্ৰ প্ৰণয়ের উত্তপ্ত বাসরশয্যার মধ্যে চক্ষু উল্মীলন করিয়া ধীরে ধীরে সংসারের কাজকর্ম, পড়াশুনার প্রতি একটু সজাগ হইয়া পাশ ফিরিল। ডাক্তারি বইগুলাকে নানা অসম্ভব স্থান হইতে উদ্ধার করিয়া ধূলা ঝাড়িতে লাগিল এবং চাপাকান-প্যান্টলুন-কয়টা রৌদ্রে দিবার উপক্ৰম করিল। S \) বিনোদিনী যখন নিতান্তই ধরা দিল না। তখন আশার মাথায় একটা ফন্দি আসিল । সে বিনোদিনীকে কহিল, “ভাই বালি, তুমি আমার স্বামীর সম্মুখে বাহির হও না কেন। পলাইয়া বেড়াও কী ७०I |” বিনোদিনী অতি সংক্ষেপে এবং সতেজে উত্তর করিল, “ছি ছি।” আশা কহিল, “কেন। মার কাছে শুনিয়াছি, তুমি তো আমাদের পর নও।” বিনোদিনী গভীরমুখে কহিল, “সংসারে আপন-পর কেহই নাই। যে আপন মনে করে সেই আপন— যে পর বলিয়া জানে, সে আপন হইলেও পর ” আশা মনে মনে ভাবিল, এ কথার আর উত্তর নাই। বাস্তবিকই তাহার স্বামী বিনোদিনীর প্রতি অন্যায় করেন, বাস্তবিকই তাহাকে পর ভাবেন এবং তাহার প্রতি অকারণে বিরক্ত হন। তোমাকে আলাপ করিতে হইবে।” মহেন্দ্ৰ হাসিয়া কহিল, “তোমার সাহস তো কম নয়।”