পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 O O রবীন্দ্র-রচনাবলী মহেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “হাসির কারণ হইতে আমি হতভাগ্য কেন বঞ্চিত হই।” বিনােদনী চমকিয়া মাথায় কাপড় টানিয়া উঠিবার উপক্রম করল। আশা তাহার হাত চাপিয়া SG মহেন্দ্ৰ হাসিয়া কহিল, “হয় আপনি বসুন আমি যাই, নয়। আপনিও বসুন আমিও বসি।” বিনোদিনী সাধারণ মেয়ের মতো আশার সহিত হাত-কাড়াকড়ি করিয়া মহাকোলাহলে লজ্জার ধুম বাধাইয়া দিল না। সহজ সুরেই বলিল, “কেবল আপনার অনুরোধেই বসিলাম, কিন্তু মনে মনে অভিশাপ দিবেন না।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “এই বলিয়া অভিশাপ দিব, আপনার যেন অনেকক্ষণ চলৎশক্তি না থাকে।” বিনোদিনী কহিল, “সে অভিশাপকে আমি ভয় করি না। কেননা, আপনার অনেকক্ষণ খুব বেশিক্ষণ হইবে না। বোধ হয়, সময় উত্তীর্ণ হইয়া আসিল ।” বলিয়া আবার সে উঠিবার চেষ্টা করিল। আশা তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “মাথা খাও আর একটু বসে।” S 8 আশা জিজ্ঞাসা করিল, “সত্য করিয়া বলো, আমার চোখের বালিকে কেমন লাগিল।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “মন্দ নয়।” আশা অত্যন্ত ক্ষুন্ন হইয়া কহিল,“তোমার কাউকে আর পছন্দই হয় না।” মহেন্দ্ৰ। কেবল একটি লোক ছাড়া । সুশৃ কহিল,"আচ্ছ, ওর সঙ্গে আর একটু ভালাে করিয়া আলাপ হউক, তার পরে বুঝব পছন্দ হয়। • || মহেন্দ্ৰ কহিল, “আবার আলাপ ! এখন বুঝি বরাবরই এমনি চলিবে ।” আশা কহিল, “ভদ্রতার খাতিরেও তো মানুষের সঙ্গে আলাপ করিতে হয়। একদিন পরিচয়ের পরেই যদি দেখাশুনা বন্ধ কর, তবে চোখের বালি কী মনে করিবে বলে দেখি। তোমার কিন্তু সকলই আশ্চর্য। আর কেউ হইলে আমন মেয়ের সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য সাধিয়া বেড়াইত, তোমার যেন একটা মস্ত বিপদ উপস্থিত হইল।” অন্য লোকের সঙ্গে তাহার এই প্রভেদের কথা শুনিয়া মহেন্দ্ৰ ভারি খুশি হইল। কহিল, “আচ্ছা, বেশ তো। ব্যস্ত হইবার দরকার কী। আমার তো পালাইবার স্থান নাই, তোমার সখীরাও পালাইবার তাড়া দেখি না- সুতরাং দেখা মাঝে মাঝে হইবেই, এবং দেখা হইলে ভদ্রতা রক্ষা করিবে, তোমার স্বামীর সেটুকু শিক্ষা আছে।” মহেন্দ্ৰ মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিল, বিনোদিনী এখন হইতে কোনো-না-কোনো ছুতায় দেখা দিবেই। ভুল বুঝিয়াছিল। বিনোদিনী কাছ দিয়াও যায় না— দৈবাৎ যাতায়াতের পথেও দেখা হয় না। পাছে কিছুমাত্র ব্যগ্রতা প্রকাশ হয় বলিয়া মহেন্দ্র বিনােদিনীর প্রসঙ্গ স্ত্রীর কাছে উত্থাপন করিতে পারে না। মাঝে মাঝে বিনোদিনীর সঙ্গলাভের জন্য স্বাভাবিক সামান্য ইচ্ছাকেও গোপন ও দমন করিতে গিয়া মহেন্দ্রের ব্যগ্ৰতা আরো যেন বাড়িয়া উঠিতে থাকে। তাহার পরে বিনোদিনীর ঔদাস্যে বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা হইবার পরদিনে মহেন্দ্ৰ নিতান্তই যেন প্ৰসঙ্গক্রমে হাস্যচ্ছলে আশাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, তোমার অযোগ্য এই স্বামীটিকে চোখের বালির কেমন লাগিল।” প্রশ্ন করিবার পূর্বেই আশার কাছ হইতে এ সম্বন্ধে উচ্ছাসপূর্ণ বিস্তারিত রিপোর্ট পাইবে, মহেন্দ্রের এরূপ দৃঢ় প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সেজন্য সবুর করিয়া যখন ফল পাইল না, তখন লীলাচ্ছলে প্রশ্নটা উত্থাপন করিল।