পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 O Q. রবীন্দ্র-রচনাবলী বিনোদিনী বড়োই রাগ করিল- তাহার জ্যোতির্ময় চক্ষু দুইটি হইতে মহেন্দ্রের প্রতি অগ্নিবাণ বর্ষণ করিয়া কহিল, “ভারি অন্যায়।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “অন্যায়, তাহার। আর সন্দেহ নাই। কিন্তু চুরিও করিলাম, অথচ চোরাই মাল ঘরে আসিল না, ইহাতে যে আমার ইহকাল পরকাল দুই গেল ! অন্যায়টাকে শেষ করিতে দিয়া তাহার পরে দণ্ড দিবেন।” আশাও বিনোদিনীকে অত্যন্ত ধরিয়া পড়িল। ছবি লওয়া হইল। কিন্তু প্ৰথম ছবিটা খারাপ হইয়া গেল। সুতরাং পরের দিন আর-একটা ছবি না লইয়া চিত্রকর ছাড়িল না। তার পরে আবার দুই সখীকে একত্র করিয়া বন্ধুত্বের চিরনিদর্শনস্বরূপ একখানি ছবি তোলার প্রস্তাবে বিনোদিনী না’ বলিতে পারিল না। কহিল, “কিন্তু এইটেই শেষ ছবি ।” শুনিয়া মহেন্দ্র সে ছবিটাকে নষ্ট করিয়া ফেলিল। এমনি করিয়া ছবি তুলিতে তুলিতে আলাপ পরিচয় বহুদূর অগ্রসর হইয়া গেল। Gł বাহির হইতে নাড়া পাইলে ছাই-চাপা আগুন আবার জ্বলিয়া উঠে। নবদম্পতির প্রেমের উৎসাহ যেটুকু স্নান হইতেছিল, তৃতীয়পক্ষের ঘা খাইয়া সেটুকু আবার জাগিয়া উঠিল। আশার হাস্যালাপ করিবার শক্তি ছিল না, কিন্তু বিনোদিনী তাহা অজস্ৰ জোগাইতে পারিত ; এইজন্য বিনোদিনীর অন্তরালে আশা ভারি একটা আশ্রয় পাইল । মহেন্দ্ৰকে সর্বদাই আমোদের উত্তেজনায় রাখিতে তাহাকে আর অসাধ্যসাধন করিতে হইত না । বিবাহের অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্র এবং আশা পরস্পরের কাছে নিজেকে নিঃশেষ করিবার উপক্ৰম করিয়াছিল— প্রেমের সংগীত একেবারেই তারস্বরের নিখাদ হইতেই শুরু হইয়াছিল- সুন্দ ভাঙিয়া না খাইয়া তাহারা একেবারে মূলধন উজাড় করিবার চেষ্টায় ছিল। এই খোপামির বন্যাকে তাহারা প্রাত্যহিক সংসারের সহজ স্রোতে কেমন করিয়া পরিণত করিবে । নেশার পরেই মাঝখানে যে অবসাদ আসে, সেটা দূর করিতে মানুষ আবার যে-নেশা চায় সে-নেশা আশা কোথা হইতে জোগাইবে । এমন সময় বিনোদিনী নবীন রঙিন পাত্ৰ ভরিয়া আশার হাতে আনিয়া দিল । আশা স্বামীকে প্ৰফুল্ল দেখিয়া আরাম পাইল । এখন আর তাহার নিজের চেষ্টা রহিল না। মহেন্দ্ৰ-বিনোদিনী যখন উপহাস-পরিহাস করিত, তখন সে কেবল প্ৰাণ খুলিয়া হাসিতে যোগ দিত। তাসখেলায় মহেন্দ্র যখন আশাকে অন্যায় ফাকি দিত তখন সে বিনোদিনীকে বিচারক মানিয়া সকরুণ অভিযোগের অবতারণা করিত। মহেন্দ্ৰ তাহাকে ঠাট্টা করিলে বা কোনো অসংগত কথা বলিলে সে প্রত্যাশা করিত, বিনোদিনী তাহার হইয়া উপযুক্ত জবাব দিয়া দিবে। এইরূপে তিনজনের সভা জমিয়া উঠিল। কিন্তু তাই বলিয়া বিনোদিনীর কাজে শৈথিল্য ছিল না। রাধাবাড়া, ঘরকন্না দেখা, রাজলক্ষ্মীর সেবা করা, সমস্ত সে নিঃশেষপূর্বক সমাধা করিয়া। তবে আমোদে যোগ দিত। মহেন্দ্র অস্থির হইয়া বলিত, “চাকরিদাসীগুলাকে না কাজ করিতে দিয়া তুমি মাটি করিবে দেখিতেছি।” বিনোদিনী বলিত, “নিজে কাজ না করিয়া মাটি হওয়ার চেয়ে সে ভালো। যাও, তুমি কলেজে যাও।” মহেন্দ্র । আজ বাদলার দিনটাতেবিনোদিনী । না সে হইবে না- তোমার গাড়ি তৈরি হইয়া আছে- কলেজে যাইতে হইবে । মহেন্দ্ৰ। আমি তো গাড়ি বারণ করিয়া দিয়াছিলাম। বিনোদিনী । আমি বলিয়া দিয়াছি।- বলিয়া মহেন্দ্রের কলেজে যাইবার কাপড় আনিয়া সম্মুখে উপস্থিত করিল।