চোখের বালি 8 ○○ আশা তাহাকে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঠেলিয়া দিল। বিহারীও এ ঠাট্টায় যোগ দিল না। আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো ঠাট্টা সহিবে না, এটুকু বিনোদিনীর কাছে এড়াইতে পারে নাই। বিহাৰী আশাকে শ্রদ্ধা করে এবং বিনোদিনীকে হালকা করিতে চায়, ইহা বিনোদিনীকে বিধিল । সে পুনরায় আশাকে কহিল, “তোমার এই ভিক্ষুক দেওরটি আমাকে উপলক্ষ করিয়া তোমারই কাছে আদর ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে— কিছু দে, ভাই ।” আশা অত্যন্ত বিরক্ত হইল। ক্ষণকালের জন্য বিহারীর মুখ লাল হইল, পরীক্ষণেই হাসিয়া কহিল, “আমার বেলাতেই কি পরের উপর বরাত চালাইবে, আর মহিনদার সঙ্গেই নগদ কারবার !” বিহারী সমস্ত মাটি করিতে আসিয়াছে, বিনোদিনীর ইহা বুঝিতে বাকি রহিল না। বুঝিল, বিহারীর সম্মুখে সশস্ত্ৰে থাকিতে হইবে। মহেন্দ্র বিরক্ত হইল। খোলসা কথায় কবিত্বের মাধুর্য নষ্ট হয়। সে ঈষৎ তীব্র স্বরেই কহিল, “বিহারী, তোমার মহিনদা কোনো কারবারে যান না— হাতে যা আছে, তাতেই তিনি সস্তুষ্ট।” বিহারী। তিনি না যেতে পারেন, কিন্তু ভাগ্যে লেখা থাকিলে কারবারের ঢেউ বাহির হইতে আসিয়াও লাগে । বিনোদিনী। আপনার উপস্থিত হাতে কিছুই নাই, কিন্তু আপনার ঢেউটাি কোন দিক হইতে আসিতেছে!-- বলিয়া সে সবকটাক্ষহস্যে আশাকে টিপিল। আশা বিরক্ত হইয়া উঠিয়া গেল। বিহারী পরাভূত হইয়া ক্ৰোধে নীরব হইল ; উঠিবার উপক্ৰম করিতেই বিনোদিনী কহিল, “হতাশ হইয়া যাবেন না, বিহারীবাবু। আমি চোখের বালিকে পাঠাইয়া দিতেছি।” বিনোদিনী চলিয়া যাইতেই সভাভঙ্গে মহেন্দ্ৰ মনে মনে রাগিল। মহেন্দ্রের অপ্ৰসন্ন মুখ দেখিয়া বিহারীর রুদ্ধ আবেগ উচ্ছসিত হইয়া উঠিল । কহিল, “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও, করো— বরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে সরলহীদয়া সাধবী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না । এখনো বলিতেছি, তাহার সর্বনাশ করিয়ো न् ।" বলিতে বলিতে বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল । মহেন্দ্র রুদ্ধরোষে কহিল, “বিহারী, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। হেঁয়ালি ছাডিয়া স্পষ্ট কথা কও ” বিহারী কহিল, “স্পষ্টই কহিব । বিনোদিনী তোমাকে ইচ্ছা করিয়া অধর্মের দিকে টানিতেছে এবং তুমি না জানিয়া মূঢ়ের মতো অপথে পা বাড়াইতেছ।” মহেন্দ্ৰ গর্জন করি যা উঠিয়া কহিল, “মিথ্যা কথা। তুমি যদি ভদ্রলোকের মেয়েকে এমন অন্যায় সন্দেহের চোখে দেখ, তবে অন্তঃপুরে তোমার আসা উচিত নয়।” এমন সময় একটি থালায় মিষ্টান্ন সাজাইয়া বিনোদিনী হাস্যমুখে তাহা বিহারীর সম্মুখে রাখিল। বিহারী কহিল, “এ কী ব্যাপার। আমার তো ক্ষুধা নাই।” বিনোদিনী কহিল, “সে কি হয়। একটু মিষ্টমুখ করিয়া আপনাকে যাইতেই হইবে।” বিহারী হাসিয়া কহিল, “আমার দরখাস্ত মঞ্জর হইল বুঝি। সমাদর আরম্ভ হইল।” বিনোদিনী অত্যন্ত টিপিয়া হাসিল ; কহিল, “আপনি যখন দেওর তখন সম্পর্কের যে জোর আছে। যেখানে দাবি করা চলে সেখানে ভিক্ষা করা কেন । আদর যে কাডিয়া লইতে পারেন। কী বলেন, মহেন্দ্ৰবাবু।” মহেন্দ্রবাবুর তখন বাক্যস্ফুর্তি হইতেছিল না। বিনোদিনী। বিহারীবাবু, লজ্জা করিয়া খাইতেছেন না, না রাগ করিয়া ? আর-কাহাকেও ডাকিয়া আনিতে হইবে ? বিহারী। কোনো দরকার নাই। যাহা পাইলাম তাহাই প্রচুর। বিনোদিনী । ঠাট্টা ? আপনার সঙ্গে পারিবার জো নাই। মিষ্টান্ন দিলেও মুখ বন্ধ হয় না।
পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।