পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 ○。 বেদির উপর বসাইয়া এক এক পেয়ালা গরম চা এবং ছােটাে রেকাবিতে দুই-একটি মিষ্টান্ন ধরিয়া দিল। বিনোদিনী বার বার বলিতে লাগিল,“ভাগ্যে বিহারীবাবু সমস্ত উদযোগ করিয়া আনিয়াছিলেন, তাই তো রক্ষা, নহিলে চা না পাইলে মহেন্দ্ৰবাবুর কী দশা হইত।” চা পাইয়া মহেন্দ্ৰ বঁাচিয়া গেল, তবু বলিল, “বিহারীর সমস্ত বাড়াবাড়ি। চড়িভাতি করিতে আসিয়াছি, এখানেও সমস্ত দস্তুরমত আয়োজন করিয়া আসিয়াছে। ইহাতে মজা থাকে না।” বিহারী কহিল, “তবে দাও ভাই তোমার চায়ের পেয়ালা, তুমি না খাইয়া মজা করে গে-বাধা দিব না ।” বেলা হয়, চাকররা আসিল না। বিহারীর বাক্স হইতে আহারাদির সর্বপ্রকার সরঞ্জাম বাহির হইতে লাগিল। চাল-ডাল, তারি-তরকারি এবং ছোটাে ছোটাে বোতলে পেষা মসলা আবিষ্কৃত হইল। বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া বলিতে লাগিল, “বিহারীবাবু, আপনি যে আমাদেরও ছাড়াইয়াছেন। ঘরে তো গৃহিণী নাই, তবে শিখিলেন কোথা হইতে।” বিহারী নিতান্ত পরিহাস করিয়া কহিল, কিন্তু বিনোদিনী গভীর হইয়া বিহারীর মুখে করুণাচক্ষের কৃপা বর্ষণ করিল। বিহারী ও বিনোদিনীতে মিলিয়া রাধাবাড়ায় প্ৰবৃত্ত হইল। আশা ক্ষীণ সংকুচিত ভাবে হস্তক্ষেপ করিতে আসিলে, বিহারী তাহাতে বাধা দিল। অপটু মহেন্দ্র সাহায্য করিবার কোনো চেষ্টাও করিল না। সে গুড়ির উপরে হেলান দিয়া একটা পায়ের উপরে আর-একটা পা তুলিয়া কম্পিত বটপত্রের উপরে রৌদ্রকিরণের নৃত্য দেখিতে লাগিল। রন্ধন প্ৰায় শেষ হইলে পর বিনোদিনী কহিল, “মহিনবাবু, আপনি ঐ বটের পাতা গনিয়া শেষ করিতে পরিবেন না, এবারে স্নান করিতে যান ।” ভূত্যের দল এতক্ষণে জিনিসপত্র লইয়া উপস্থিত হইল। তাহাদের গাড়ি পথের মধ্যে ভাঙিয়া গিয়াছিল। তখন বেলা দুপুর হইয়া গেছে। আহারান্তে সেই বটগাছের তলায় তাস খেলিবার প্রস্তাব হইল- মহেন্দ্ৰ কোনোমতেই গা দিল না। এবং দেখিতে দেখিতে ছায়াতলে ঘুমাইয়া পড়িল। আশা বাড়ির মধ্যে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া বিশ্রামের উদযোগ করিল। বিনোদিনী মাথার উপরে একটুখানি কাপড় তুলিয়া দিয়া কহিল, “আমি তবে ঘরে যাই।” বিহারী কহিল, “কোথায় যাইবেন, একটু গল্প করুন। আপনাদের দেশের কথা বলুন !” ক্ষণে ক্ষণে উষ্ণ মধ্যাহের বাতাস তরুপল্লব মমরিত করিয়া চলিয়া গেল, ক্ষণে ক্ষণে দিঘির পাড়ে জামগাছের ঘনপত্রের মধ্য হইতে কোকিল ডাকিয়া উঠিল। বিনোদিনী তাহার ছেলেবেলাকার কথা বলিতে লাগিল, তাহার ব্যাপম্যায়ের কথা, তাহার বাল্যােসাথির কথা । বলিতে বলিতে তাহার মাথা হইতে কাপড়টুকু খসিয়া পড়িল , বিনোদিনীর মুখে খরযৌবনের যে একটি দীপ্তি সর্বদাই বিরাজ করিত, বাল্যস্মৃতির ছায়া আসিয়া তাহাকে স্নিগ্ধ করিয়া দিল। বিনোদিনীর চক্ষে যে কৌতুকতীব্ৰ কটাক্ষ দেখিয়া তীক্ষদৃষ্টি বিহারীর মনে এ পর্যন্ত নানাপ্রকার সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল, সেই উজ্জ্বলকৃষ্ণ জ্যোতি যখন একটি শান্তসজল রেখায় স্নান হইয়া আসিল তখন বিহারী যেন আর-একটি মানুষ দেখিতে পাইল। এই দীপ্তিমণ্ডলের কেন্দ্ৰস্থলে কোমল হৃদয়টুকু এখনো সুধাধারায় সরস হইয়া আছে, অপরিতৃপ্ত রঙ্গরস কৌতুকবিলাসের দহন।জুলায় এখনো নারীপ্রকৃতি শুষ্ক হইয়া যায় নাই। বিনোদিনী সলজ সতীন্ত্রীভাবে একান্ত-ভক্তিভরে পতিসেবা করিতেছে, কল্যাণপরিপূর্ণা জননীর মতো সস্তানকে কোলে ধরিয়া আছে, এ ছবি ইতিপূর্বে মুহুর্তের জন্যও বিহারীর মনে উদিত হয় নাই— আজ যেন রঙ্গমঞ্চের পটখানা ক্ষণকালের জন্য উড়িয়া গিয়া ঘরের ভিতরকার একটি মঙ্গলদৃশ্য তাহার চোখে পড়িল। বিহারী ভাবিল, বিনোদিনী বাহিরে বিলাসিনী যুবতী বটে, কিন্তু তাহার অন্তরে একটি পূজারিতা নারী নিরশনে তপস্যা করিতেছে।