পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বলিয়া বালিশ অবলম্বন করিয়া শুইলেন, বিনোদিনী আস্তে আস্তে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে व्लाव्लिा । মহেন্দ্র একবার মার কপালে হাত দিয়া দেখিল, তাহার নাভী পরীক্ষা করিল। রাজলক্ষ্মী হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, “নাড়ী দেখিয়া তো ভারি বোঝা যায়। তোর আর ভাবিতে হইবে না, আমি বেশ আছি।” বলিয়া অত্যন্ত দুর্বলভাবে পােশ ফিরিয়া শুইলেন। মহেন্দ্ৰ বিনোদিনীকে কোনোপ্রকার বিদায়সম্ভাষণ না করিয়া রাজলক্ষ্মীকে প্ৰণাম করিয়া চলিয়া 5ऴ् | ని বিনোদিনী মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “ব্যাপারখানা কী ! অভিমান, না রাগ, না ভয় ? আমাকে দেখাইতে চান, আমাকে কেয়ার করেন না ? বাসায় গিয়া থাকিবেন ? দেখি কতদিন থাকিতে পারেন ?” কিন্তু বিনোদিনীরও মনে মনে একটা অশান্ত ভাব উপস্থিত হইল। " মহেন্দ্ৰকে সে প্ৰতিদিন নানা পাশে বদ্ধ ও নানা বাণে বিদ্ধ করিতেছিল, সে-কাজ গিয়া বিনোদিনী যেন এ-পাশ ও-পাশ করিতে লাগিল। বাড়ি হইতে তাহার সমস্ত নেশা চলিয়া গেল। মহেন্দ্রবর্জিত আশা তাহার কাছে নিতান্তই স্বাদহীন। আশার প্রতি মহেন্দ্রের সোহাগ-যত্ন বিনোদিনীর প্রণয়বঞ্চিত চিত্তকে সর্বদাই আলোড়িত করিয়া তুলিত— তাহাতে বিনোদিনীর বিরাহিণী কল্পনাকে যে-বেদনায় জাগরকে করিয়া রাখিত তাহার মধ্যে উগ্ৰ উত্তেজনা ছিল । যে-মহেন্দ্ৰ তাহাকে তাহার সমস্ত জীবনের সার্থকতা হইতে ভ্ৰষ্ট করিয়াছে, যে-মহেন্দ্ৰ তাহার মতো স্ত্রীরত্বকে উপেক্ষা করিয়া আশার মতো ক্ষীণবুদ্ধি দীনপ্রকৃতি বালিকাকে বরণ করিয়াছে, তাহাকে বিনোদিনী ভালোবাসে কি বিদ্বেষ করে, তাহাকে কঠিন শাস্তি দিবে না। তাহাকে হৃদয়সমর্পণ করিবে, তাহা বিনোদিনী ঠিক করিয়া বুঝিতে পারে নাই। একটা জ্বালা মহেন্দ্ৰ তাহার অস্তরে জ্বালাইয়াছে, তাহা হিংসার না প্রেমের, না দুয়েরই মিশ্রণ, বিনোদিনী তাহা ভাবিয়া পায় না ; মনে মনে তীব্ৰ হাসি হাসিয়া বলে, “কোনো নারীর কি আমার মতো এমন দশা হইয়াছে। আমি মরিতে চাই কি মারিতে চাই, তাহা বুঝিতেই পারিলাম না । কিন্তু যে কারণেই বল, দগ্ধ হইতেই হউক বা দগ্ধ করিতেই হউক, মহেন্দ্রকে তাহার একান্ত প্রয়োজন । সে তাহার বিষদিগ্ধ অগ্নিবাণ জগতে কোথায় মোচন করিবে । ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বিনোদিনী কহিল, “সে যাইবে কোথায় । সে ফিরিবেই । সে আমার ।” আশা ঘর পরিষ্কার করিবার ছুতা করিয়া সন্ধ্যার সময় মহেন্দ্রের বাহিরের ঘরে, মাথার-তেলে-দগ-পড়া মহেন্দ্রের বসিবার কেদারা, কাগজপত্র-ছড়ানো ডেস্ক, তাহার বই, তাহার ছবি প্রভৃতি জিনিসপত্র বার বার নাড়াচাড়া এবং অঞ্চল দিয়া ঝাড়-পোচ করিতেছিল। এইরূপে মহেন্দ্রের সকল জিনিস নানা রূপে স্পর্শ করিয়া, একবার রাখিয়া, একবার তুলিয়া, আশার বিরহসন্ধ্যা কাটিতেছিল। বিনোদিনী ধীরে ধীরে তাহার কাছে আসিয়া দাড়াইল ; আশা ঈষৎ লজিত হইয়া তাহার নাড়াচাড়ার কাজ রাখিয়া দিয়া, কী যেন খুঁজিতেছে এমনিতরো ভান করিল। বিনোদিনী গভীরমুখে আশা মুখে একটুখানি হাসি জাগাইয়া কহিল, “কিছুই না, ভাই।” বিনোদিনী তখন আশার গলা জড়াইয়া কহিল, “কেন ভাই বালি, ঠাকুরপো এমন করিয়া চলিয়া গেলেন কেন ।” আশা বিনোদিনীর এই প্ৰশ্নমাত্ৰেই সংশয়ান্বিত সশঙ্কিত হইয়া উত্তর করিল, “তুমি তো জােনই, ভাই- কালেজে তাহার বিশেষ কাজ পড়িয়াছে বলিয়া গেছেন।” বিনোদিনী ডান হাতে আশার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া যেন করুণায় বিগলিত হইয়া স্তব্ধভাবে একবার তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল এবং দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। আশার বুক দমিয়া গেল। নিজেকে সে নির্বোিধ এবং বিনোদিনীকে বুদ্ধিমতী বলিয়া জানিত ।