পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 d. Ve রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী SO অনতিকাল পরেই মহেন্দ্ৰ তাহার ছাত্রাবাসে চেনা হাতের অক্ষরে একখানি চিঠি পাইল। দিনের বেলা গোলমালের মধ্যে খুলিল না— বুকের কাছে পকেটের মধ্যে পুরিয়া রাখিল। কলেজে লেকচার শুনিতে শুনিতে, হাসপাতাল ঘুরিতে ঘুরিতে, হঠাৎ এক-একবার মনে হইতে লাগিল, ভালোবাসার একটা পাখি তাহার বুকের নীড়ে বাসা করিয়া ঘুমাইয়া আছে। তাহাকে জাগাইয়া তুলিলেই তাহার সমস্ত কোমল কৃজন কানে ধ্বনিত হইয়া উঠিবে। সন্ধ্যায় এক সময় মহেন্দ্র নির্জন ঘরে ল্যাম্পের আলোকে চৌকিতে বেশ করিয়া হেলান দিয়া আরাম করিয়া বসিল। পকেট হইতে তাহার দেহতাপতপ্ত চিঠিখানি বাহির করিয়া লইল। অনেকক্ষণ চিঠি না খুলিয়া লেফাফার উপরকার শিরোনামা নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্ৰ জানিত, চিঠির মধ্যে বেশি কিছু কথা নাই। আশা নিজের মনের ভাব ঠিকমত ব্যক্ত করিয়া লিখিতে পরিবে, এমন সম্ভাবনা ছিল না। কেবল তাহার কাচা অক্ষরে বঁাকা লাইনে তাহার মনের কোমল কথাগুলি কল্পনা করিয়া লইতে হইবে। আশার কঁচা হাতে বহু যত্নে লেখা নিজের নামটি পড়িয়া মহেন্দ্ৰ নিজের নামের সঙ্গে যেন একটা রাগিণী শুনিতে পাইল— তাহা সাধবী নারী-হৃদয়ের অতি নিভৃত বৈকুণ্ঠলোক হইতে একটি নির্মল প্রেমের সংগীত । এই দুই-একদিনের বিচ্ছেদে মহেন্দ্রের মন হইতে দীর্ঘ-মিলনের সমস্ত অবসাদ দূর হইয়া সরলা বধূর নবপ্ৰেমে উদদ্ভাসিত সুখস্মৃতি আবার উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। শেষাশেষি প্রাত্যহিক ঘরকন্নার খুঁটিনাটি অসুবিধা তাহাকে উত্ত্যক্ত করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে-সমস্ত অপসারিত হইয়া কেবলমাত্র কর্মহীন কারণহীন একটি বিশুদ্ধ প্ৰেমানন্দের আলোকে আশার মানসীমূর্তি তাহার মনের মধ্যে প্ৰাণ পাইয়া উঠিয়াছে। বুলাইয়া লইল। একদিন মহেন্দ্র যে-এসেন্স আশাকে উপহার দিয়াছিল, সেই এসেন্সের গন্ধ চিঠির কাগজ হইতে উতলা দীর্ঘনিশ্বাসের মতো মহেন্দ্রের হৃদয়ের মধ্যে প্ৰবেশ করিল। ভাজ খুলিয়া মহেন্দ্ৰ চিঠি পড়িল। কিন্তু এ কী। যেমন বঁাকাচোরা লাইন, তেমন সাদাসিধা ভাষা নয় তো । কাচ-কাচা অক্ষর, কিন্তু কথাগুলি তো তাহার সঙ্গে মিলিল না। লেখা আছে— “প্রিয়তম, যাহাকে ভুলিবার জন্য চলিয়া গেছ, এ লেখায় তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিব কেন । যে সে কেন মাটির সঙ্গে মাটি হইয়া মিশিয়া গেল না ! “কিন্তু এটুকুতে তোমার কী ক্ষতি হইবে, নাথ। নাহয় ক্ষণকালের জন্য মনে পড়িলই বা । মনে তাহাতে কতটুকুই বা বাজিবে। আর, তোমার অবহেলা যে কাটার মতো আমার পাজরের ভিতরে প্ৰবেশ করিয়া রহিল। সকল দিন, সকল রাত, সকল কাজ, সকল চিন্তার মধ্যে যে দিকে ফিরি, সেই দিকেই যে আমাকে বিধিতে লাগিল। তুমি যেমন করিয়া ভুলিলে, আমাকে তেমনি করিয়া ভুলিবার একটা উপায় বলিয়া দাও । “নাথ, তুমি যে আমাকে ভালোবাসিয়াছিলে, সে কি আমারই অপরাধ। আমি কি স্বপ্নেও এত সৌভাগ্য প্ৰত্যাশা করিয়াছিলাম। আমি কোথা হইতে আসিলাম, আমাকে কে জানিত। আমাকে যদি না চাহিয়া দেখিতে, আমাকে যদি তোমার ঘরে বিনা-বেতনের দাসী হইয়া থাকিতে হইত, আমি কি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারিতাম। তুমি নিজেই আমার কোন গুণে ভুলিলে প্ৰিয়তম, কী দেখিয়া আমার এত আদর বাড়াইলে । আর, আজ বিনা-মেঘে যদি বজপােতই হইল, তবে সে বাজ কেবল দগ্ধ করিল কেন । একেবারে দেহ,মন কেন ছাই করিয়া দিল না। “এই দুটাে দিনে অনেক সহ্য করিলাম, অনেক ভাবিলাম, কিন্তু, একটা কথা বুঝিতে পারিলাম না— ঘরে থাকিয়াও কি তুমি আমাকে ফেলিতে পারিতে না। আমার জন্যও কি তোমার ঘর ছাড়িয়া