পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8S a যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল। আমি কি তোমার এতখানি জুড়িয়া আছি। আমাকে তোমার ঘরের কোণে, তোমার দ্বারের বাহিরে ফেলিয়া রাখিলেও কি আমি তোমার চোখে পড়িতাম। তাই যদি হয়, তুমি কেন গেলে, আমার কি কোথাও যাইবার পথ ছিল না। ভাসিয়া আসিয়াছি, ভাসিয়া যাইতাম।” এ কী চিঠি। এ ভাষা কাহার, তাহা মহেন্দ্রের বুঝিতে বাকি রহিল না। অকস্মাৎ আহত মুছিতের মতো মহেন্দ্র সে-চিঠিখানি লইয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিল। যে-লাইনে রেলগাড়ির মতো তাহার। মন পূর্ণবেগে ছুটিয়াছিল, সেই লাইনেই বিপরীত দিক হইতে একটা ধাক্কা খাইয়া লাইনের বাহিরে তাহার মনটা যেন উলটাপালটা স্তুপাকার বিকল হইয়া পড়িয়া থাকিল। অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া আবার সে দুইবার তিনবার করিয়া পড়িল। কিছুকাল যাহা সুদূর আভাসের মতো ছিল, আজ তাহা যেন ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার জীবনাকাশের এক কোণে যে ধূমকেতুটা ছায়ার মতো দেখাইতেছিল, আজ তাহার উদ্যত বিশাল পুচ্ছ অগ্নিরেখায় দীপ্যমান হইয়া দেখা দিল । এ চিঠি বিনোদিনীরই। সরলা আশা নিজের মনে করিয়া তাহা লিখিয়াছে। পূর্বে যে কথা সে কখনো ভাবে নাই,বিনোদিনীর রচনামত চিঠি লিখিতে গিয়া সেই—সব কথা তাহার মনে জাগিয়া উঠিতে লাগিল। নকল-করা কথা বাহির হইতে বদ্ধমূল হইয়া তাহার আন্তরিক হইয়া গেল; যে-নৃতন বেদনার সৃষ্টি হইল, এমন সুন্দর করিয়া তাহা ব্যক্ত করিতে আশা কখনোই পারিত না। সে ভাবিতে লাগিল, "সখী আমার মনের কথা এমন ঠিকটি বুঝিল কী করিয়া। কেমন করিয়া এমন ঠিকটি প্রকাশ করিয়া বলিল ।” অন্তরঙ্গ সখীকে আশা আরো যেন বেশি আগ্রহের সঙ্গে আশ্রয় করিয়া ধরিল, কারণ, যে-ব্যথাটা তাহার মনের মধ্যে, তাহার ভাষাটি তাহার সখীর কাছে— সে এতই নিরুপায়। মহেন্দ্ৰ চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া ভ্ৰ কুঞ্চিত করিয়া বিনোদিনীর উপর রাগ করিতে, অনেক চেষ্টা করিল, মাঝে থেকে রাগ হইল আশার উপর। দেখো দেখি, আশার এ কী মূঢ়তা, স্বামীর প্রতি এ কী অত্যাচার।’ বলিয়া চৌকিতে বসিয়া পড়িয়া প্ৰমাণস্বরূপ চিঠিখানা আবার পডিল। পিডিয়া ভিতরে ভিতরে একটা হৰ্ষসঞ্চার হইতে লাগিল। চিঠিখানাকে সে আশারই চিঠি মনে করিয়া পড়িবার অনেক চেষ্টা করিল। কিন্তু এ ভাষায় কোনোমতেই সরলা আশাকে মনে করাইয়া দেয় না। দু-চার লাইন পড়িবামাত্র একটা সুখোন্মাদকর সন্দেহ ফেনিল মদের মতো মনকে চারি দিকে ছাপাইয়া উঠিতে থাকে। এই প্রচ্ছন্ন। অথচ ব্যক্ত, নিষিদ্ধ অথচ নিকটাগত, বিষাক্ত অথচ মধুর, একই কালে উপহৃত অথচ প্রত্যাহৃত প্রেমের আভাস মহেন্দ্ৰকে মাতাল করিয়া তুলিল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল, নিজের হাতে-পায়ে কোথাও এক জায়গায় ছুরি বসাইয়া বা আর-কিছু করিয়া নেশা ছুটাইয়া মনটাকে আর-কোনো দিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়। টেবিলে সজোরে মুষ্টি বসাইয়া চৌকি হইতে লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, “দূর করো, চিঠিখানা পুড়াইয়া ফেলি।” বলিয়া চিঠিখানি ল্যাম্পের কাছাকাছি লইয়া গেল। পুড়াইল না, আর-একবার পড়িয়া ফেলিল। পরদিন ভূত্য টেবিল হইতে কাগজপোড়া ছাই অনেক ঝাড়িয়া ফেলিয়াছিল। কিন্তু তাহা আশার চিঠির ছাঁই নহে, চিঠির উত্তর দিবার অনেকগুলা অসম্পূর্ণ ༄ S ইতিমধ্যে আরো এক চিঠি আসিয়া উপস্থিত হইল - ‘তুমি আমার চিঠির উত্তর দিলে না ? ভালোই করিয়াছ । ঠিক কথা তো লেখা যায় না ; তোমার যা জবাব, সে আমি মনে মনে বুঝিয়া লইলাম । ভক্ত যখন তাহার দেবতাকে ডাকে, তিনি কি মুখের কথায় তাহার উত্তর দেন । দুখিনীর বিন্ধপত্ৰখানি চরণতলে বোধ করি স্থান পাইয়াছে ! “কিন্তু ভক্তের পূজা লইতে গিয়া শিবের যদি তপোভঙ্গ হয়, তবে তাহাতে রাগ করিয়ো না, হৃদয়দেব ! তুমি বর দাও বা না দাও, চোখ মেলিয়া চাও বা না চাও, জানিতে পার বা না পাের, পূজা না ગ || ર૧