পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8>公 বিহারী কহিল, “না, ঠাট্টা নয়, এখনই বাড়ি চলো।” মহেন্দ্ৰ বাড়ি ফিরিবার জন্য উদ্যত হইয়াই ছিল ; বিহারীর অনুরোধ শুনিয়া সে হঠাৎ নিজেকে ভুলাইল, যেন বাড়ি যাইবার জন্য তাহার কিছুমাত্র আগ্রহ নাই। কহিল, “সে কি হয়, বিহারী। তা হলে আমার বৎসরটাই নষ্ট হইবে।” ভুলাইবার চেষ্টা করিয়ো না। তুমি অন্যায় করিতেছ।” মহেন্দ্র । কার 'পরে অন্যায় করিতেছি জিজসাহেব ! বিহারী রাগ করিয়া বলিল, “তুমি যে চিরকাল হৃদয়ের বড়াই করিয়া আসিয়াছ, তোমার হৃদয় গেল কোথায় মহিনদা ।” মহেন্দ্ৰ । সম্প্রতি কলেজের হাসপাতালে। বিহারী। থামো মহিনদা, থামো। তুমি এখানে আমার সঙ্গে হাসিয়া ঠাট্টা করিয়া কথা কহিতেছ, সেখানে আশা তোমার বাহিরের ঘরে, অন্দরের ঘরে কঁাদিয়া কাদিয়া বেড়াইতেছে। আশার কান্নার কথা শুনিয়া হঠাৎ মহেন্দ্রের মন একটা প্ৰতিঘাত পাইল ! জগতে আর যে কাহারও সুখদুঃখ আছে, সে কথা তাহার নূতন নেশার কাছে স্থান পায় নাই। হঠাৎ চমক লাগিল, জিজ্ঞাসা । বিহারী বিরক্ত হইয়া কহিল, “সে কথা তুমি জান না, আমি জানি ?” মহেন্দ্ৰ। তোমার মহিনদা সর্বজ্ঞ নয় বলিয়া যদি রাগ করিতেই হয় তো মহিনদার সৃষ্টিকর্তার উপর রাগ করে । আশার সেই অশ্রুসিক্ত মুখখানি মনে পডিয়া বিহারীর প্রায় কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল। বিহারার এই প্ৰবল আবেগ দেখিয়া মহেন্দ্ৰ আশ্চর্য হইয়া গেল। মহেন্দ্ৰ জানিত বিহারীর হৃদয়ের বালাই নাই— এ উপসর্গ কবে জুটিল। যেদিন কুমারী। আশাকে দেখিতে গিয়াছিল, সেই দিন হইতে নাকি ! বেচারা বিহারী। মহেন্দ্ৰ মনে মনে তাহাকে বেচারা বলিল বটে, কিন্তু দুঃখবোধ না করিয়া বরঞ্চ একটু আমোদ পাইল । আশার মনটি একান্তভাবে যে কোন দিকে, তাহা মহেন্দ্ৰ নিশ্চয় জানিত । ‘অন্য লোকের কাছে যাহারা বাঞ্ছার ধন, কিন্তু আয়ত্তের অতীত, আমার কাছে তাহারা চিরদিনের জন্য আপনি ধরা দিয়াছে’, ইহাতে মহেন্দ্র বক্ষের মধ্যে একটা গর্বের স্ফীতি অনুভব করিল। মহেন্দ্ৰ বিহারীকে কহিল, “আচ্ছা চলো, যাওযা যাক। তবে একটা গাড়ি ডাকো ।” སྡེ་སྡེ་ মহেন্দ্র ঘরে ফিরিয়া আসিবামাত্র তাহার মুখ দেখিয়াই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের কিয়াশার মতো এক মুহূর্তেই কাটিয়া গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করিয়া লজায় মহেন্দ্রের সামনে সে যেন মুখ তুলিতেই পারিল না। মহেন্দ্র তাহার উপরে ভৎসনা করিয়া কহিল, “এমন অপবাদ দিয়া চিঠিগুলো লিখিলে কী কবিয়া ।” বলিয়া পকেট হইতে বহুবার পঠিত সেই চিঠি তিনখানি বাহিব করিল। আশা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “তোমার পায়ে পড়ি, ও চিঠিগুলো ছিড়িয়া ফেলো ?” বলিয়া মহেন্দ্রের হাত হইতে চিঠিগুলা লাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পডিল। মহেন্দ্ৰ তাহাকে নিরস্ত কবিয়া সেগুলি পকেটে পুরিল। কহিল, “আমি কর্তব্যের অনুরোধে গেলাম, আর তুমি আমার অভিপ্রায় বুঝিলে না ? আমাকে সন্দেহ করিলে ?” আশা ছলছল চোখে কহিল, “এবারকার মতো আমাকে মাপ করো। এমন আর কখনোই হইবে יין וף মহেন্দ্ৰ কহিল, “কখনো না ?”