পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SR 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সেখানে কেবল মন্দই হইবে। দে ভাই, আমাকে ছাড়িয়া দে, আমি আমার জঙ্গলের মধ্যে চলিয়া যাই।” আশা চিবুকে হাত দিয়া বিনোদিনীর মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিল, “লক্ষ্মীটি ভাই, আমন কথা বলিস নে- তোকে ছাড়িয়া আমি থাকিতে পারিব না- আমাকে ছাডিয়া যাইবার কথা কেন আজ তোর মনে আসিল ।” মহেন্দ্রের দেখা না পাইয়া বিহারী কোনো-একটা ছুতায় পুনর্বার বিনোদিনীর ঘরে আসিয়া মহেন্দ্ৰ ও আশার মধ্যবর্তী আশঙ্কার কথাটা আর-একটু স্পষ্ট করিয়া শুনিবার জন্য উপস্থিত হইল। মহেন্দ্ৰকে পরদিন সকালে তাহাদের বাড়ি খাইতে যাইতে বলিবার জন্য বিনোদিনীকে অনুরোধ করিবার উপলক্ষ লইয়া সে উপস্থিত হইল। “বিনোদ-বোঠান” বলিয়া ডাকিয়াই হঠাৎ কেরোসিনের উজ্জ্বল আলোকে বাহির হইতেই আলিঙ্গনবদ্ধ সাশ্রুনেত্ৰ দুই সখীকে দেখিয়াই থমকিয়া দাড়াইল। আশার হঠাৎ মনে হইল, নিশ্চয়ই বিহারী তাহার চোখের বালিকে কোনো অন্যায় নিন্দা করিয়া কিছু বলিয়াছে, তাই সে আজ এমন করিয়া চলিয়া যাইবার কথা তুলিয়াছে। বিহারীবাবুর ভারি অন্যায়। উহার মন ভালো নয়। আশা বিরক্ত হইয়া বাহির হইয়া আসিল । বিহারীও বিনোদিনীর প্রতি ভক্তির মাত্ৰা চড়াইয়া বিগলিত হৃদয়ে দ্রুত প্ৰস্থান করিল। সেদিন রাত্ৰে মহেন্দ্ৰ আশাকে কহিল, “চুনি, আমি কাল সকালের প্যাসেঞ্জারেই কাশী চলিয়া যাইব ।” আশার বক্ষঃস্থল ধক করিয়া উঠিল— কহিল, “কেন।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “কাকীমাকে অনেক দিন দেখি নাই ।” শুনিয়া আশা বড়োই লজ্জাবোধ করিল ; এ কথা পূর্বেই তাহার মনে উদয় হওয়া উচিত ছিল ; নিজের সুখদুঃখের আকর্ষণে স্নেহময়ী মাসিমাকে সে যে ভুলিয়াছিল, অথচ মহেন্দ্ৰ সেই মহেন্দ্ৰ কহিল, “তিনি আমারই হাতে তাহার সংসারের একমাত্র স্নেহের ধনকে সমপণ করিয়া দিয়া চলিয়া গেছেন- তাহাকে একবার না দেখিয়া আমি কিছুতেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না।” বলিতে বলিতে মহেন্দ্রের কণ্ঠ বাপরুদ্ধ হইয়া আসিল; স্নেহপূর্ণ নীরব আশীর্বাদ ও অব্যক্ত মঙ্গলকামনার সহিত বারংবার সে আশার ললাট ও মস্তকের উপর দক্ষিণ করতল চালনা করিতে লাগিল। আশা এই অকস্মাৎ মেহাবেগের সম্পৰ্ণ মর্ম বুঝিতে পারিল না, কেবল তাহার হৃদয় বিগলিত হইয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। আজই সন্ধাবেলায় বিনোদিনী তাহাকে অকারণ স্নেহাতিশয্যে যে-সব কথা বলিয়াছিল, তাহা মনে পড়িল। উভয়ের মধ্যে কোথাও কোনো যোগ আছে কি না, তাহা সে কিছুই বুঝিল না। কিন্তু মনে হইল, যেন ইহা তাহার জীবনে কিসের একটা সূচনা। ভালো কি মন্দ কে ७Gन्म | ভয়ব্যাকুলচিত্তে সে মহেন্দ্ৰকে বাহুপাশে বদ্ধ করিল। মহেন্দ্ৰ তাহার সেই অকারণ আশঙ্কার রিল। কহিল, “চুনি, তোমার উপর তোমার পুণ্যবতী মাসিমার আশীর্বাদ আবেশ অনুভব করিতে পারি আছে, তোমার কোনো ভয় নাই, কোনো ভয় নাই । তিনি তোমারই মঙ্গলের জন্য তাহার সমস্ত ত্যাগ করিয়া গেছেন, তোমার কখনো কোনো অকল্যাণ হইতে পারে না।” আশা তখন দৃঢ়চিত্তে সমস্ত ভয় দূর করিয়া ফেলিল; স্বামীর এই আশীর্বাদ অক্ষয়কবাঁচের মতো গ্রহণ করিল। সে মনে মনে বারংবার তাহার মাসিমার পবিত্ৰ পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইতে লাগিল, এবং একাগ্রামনে কহিল, “মা, তোমার আশীর্বাদ আমার স্বামীকে সর্বদা রক্ষা করুক !” পরদিনে মহেন্দ্ৰ চলিয়া গেল, বিনোদিনীকে কিছুই বলিয়া গেল না। বিনোদিনী মনে মনে কহিল, “নিজে অন্যায় করা হইল, আবার আমার উপরে রাগ ! এমন সাধু তো দেখি নাই। কিন্তু এমন সাধুত্ব বেশিদিন টেকে না ।”