পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܟܠ 8 জানাইল, বিনোদিনীর কথার উল্লেখমাত্ৰ করিল না। এখন কলেজ খোলা, কাশীতে মহেন্দ্রের বেশি দিন থাকিবার কথা নয়। কিন্তু কঠিন রোগের পর স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার মধ্যে গিয়া আরোগ্যলাভের যে সুখ, মহেন্দ্ৰ কাশীতে অন্নপূর্ণার নিকটে থাকিয়া প্রতিদিন সেই সুখ অনুভব করিতেছিল- তাই একে একে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল। নিজের সঙ্গে নিজের যে একটা বিরোধ জন্মিবার উপক্রম হইয়াছিল, সেটা দেখিতে দেখিতে দূর হইয়া গেল। কয়দিন সর্বদা ধর্মপরায়ণা অন্নপূর্ণার মেহমুখচ্ছবির সম্মুখে থাকিয়া, সংসারের কর্তব্যপালন এমনি সহজ ও সুখকর মনে হইতে লাগিল যে, তাহার পূর্বেকার আতঙ্ক হাস্যকর বোধ হইল। মনে হইল, বিনোদিনী কিছুই না। এমন-কি, তাহার মুখের চেহারাই মহেন্দ্ৰ স্পষ্ট করিয়া মনে আনিতে পারে না। অবশেষে মহেন্দ্র খুব জোর করিয়াই মনে মনে কহিল, “আশাকে আমার হৃদয় হইতে এক চুল সরাইয়া বসিতে পারে, এমন তো আমি কোথাও কাহাকেও দেখিতে পাই না।” মহেন্দ্ৰ অন্নপূর্ণাকে কহিল, “কাকীমা, আমার কালেজ কামাই যাইতেছে— এবারকার মতো তবে আসি। যদিও তুমি সংসারের মায়া কাটাইয়া একান্তে আসিয়া আছ— তবু অনুমতি করো মাঝে মাঝে আসিয়া তোমার পায়ের ধুলা লইয়া যাইব ।” মহেন্দ্ৰ গৃহে ফিরিয়া আসিয়া যখন আশাকে তাহার মাসির স্নেহােপহার সিঁদুরের কোটা ও একটি সাদা পাথরের চুমকি ঘটি দিল, তখন তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। মাসিমার সেই পরামস্নেহময় ধৈর্য ও মাসিমার প্রতি তাহদের ও তাহার শাশুড়ির নানাপ্রকার উপদ্রব স্মরণ করিয়া তাহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। স্বামীকে জানাইল, “আমার বড়ো ইচ্ছা করে, আমি একবার মাসিমার কাছে গিয়া তাহার ক্ষমা ও পায়ের ধূলা লইয়া আসি। সে কি কোনোমতেই ঘটিতে পারে କ୩ | মহেন্দ্ৰ আশার বেদনা বুঝিল, এবং কিছুদিনের জন্য কাশীতে সে তাহার মাসিমার কাছে যায়, ইহাতে তাহার সম্মতিও হইল। কিন্তু পুনর্বার কালেজ কামাই কবিয়া আশাকে কাশী পৌছাইয়া দিতে তাহার দ্বিধা বোধ হইতে লাগিল । আশা কহিল, “ জেঠাইমা তো অল্পদিনের মধ্যেই কাশী যাইবেন, সেই সঙ্গে গেলে কি ক্ষতি আছে ।” মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীকে গিয়া কহিল, “মা, বউ একবার কাশীতে কাকীমাকে দেখিতে যাইতে চায়।” রাজলক্ষ্মী শ্লেষবাকো কহিলেন, “বউ যাইতে চান তো অবশ্যই যাইবেন, যাও, তাহাকে লইয়া Tig মহেন্দ্ৰ যে আবার অন্নপূণার কাস্থে যাতায়াত আরম্ভ করিল, ইহা রাজলক্ষ্মীর ভালো লাগে নাই। বধুর যাইবার প্রস্তাবে তিনি মনে মনে আরো বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। মহেন্দ্ৰ কহিল, “আমার কালেজ আছে, আমি রাখিতে যাইতে পারিব না। তাহার জেঠামশায়ের সঙ্গে যাইবে ।” রাজলক্ষ্মা কহিলেন, “ সে তো ভালো কথা । জেঠামশায়রা বড়োলোক, কখনো আমাদের মতো গরিবের ছায়া মাডান না, তাহদের সঙ্গে যাইতে পারিলে কত গৌরব !” মাতার উত্তরোত্তর শ্লেষবাকো মহেন্দ্রের মন একেবারে কঠিন হইয়া বাকিল। সে কোনো উত্তর না। দিয়া আশাকে কাশী পাঠাইতে দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ হইয়া চলিযা গেল । বিহারী যখন রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিল, রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও বিহারী, শুনিয়াছিস, আমাদের বউমা যে কাশী যাইতে ইচ্ছা করিয়াছেন।” বিহারী কহিল, “বল কী মা, মহিনদা আবার কালেজ কামাই করিয়া কাশী যাইবে ?” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “না না, মহিন কেন যাইবেন । তা হইলে আর বিবিয়ানা হইল কই । মহিন এখানে থাকিবেন, বউ তাহার জেঠা মহারাজের সঙ্গে কাশী যাইবেন । সবাই সাহেব-বিবি হইয়া উঠিল।” বিহারী মনে মনে উদবিগ্ন হইল, বর্তমান কালের সাহেবিয়ানা স্মরণ করিয়া নহে। বিহারী ভাবিতে