পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 RS হইয়া উঠিল। নাহয় বিনোদিনী শুনিয়াছে, মহেন্দ্ৰ তাহাকে ভালোবাসে না— তাহাতে দোষ কী । নাহয় এই কথায় অভিমানিনী বিনোদিনী তাহার উপর হইতে মন সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিবে— তাহাতেই বা ক্ষতি কী। ঝড়ের সময় নীেকার শিকল যেমন নোঙরকে টানিয়া ধরে, মহেন্দ্র তেমনি ব্যাকুলতার সঙ্গে আশাকে যেন অতিরিক্ত জোর করিয়া ধরিল। রাত্ৰে মহেন্দ্ৰ আশার মুখ বক্ষের কাছে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চুনি, তুমি আমাকে কতখানি আশা ভাবিল, “এ কেমন প্রশ্ন। বিহারীকে লইয়া অত্যন্ত লজাজনক যে-কথাটা উঠিয়াছে, তাহাতেই কি তাহার উপরে সংশয়ের ছায়া পড়িয়াছে।” সে লিজায় মরিয়া গিয়া কহিল, “ছি ছি, আজি তুমি এমন প্রশ্ন কেন করিলে। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে খুলিয়া বলো- আমার ভালোবাসায় তুমি কবে কোথায় কী অভাব দেখিয়াছ।” মহেন্দ্ৰ আশাকে পীড়ন করিয়া তাহার মাধুর্য বাহির করিবার জন্য কহিল, “তবে তুমি কাশী যাইতে চাহিতেছ। কেন ।” আশা কহিল, “আমি কাশী যাইতে চাই না, আমি কোথাও যাইব না।” মহেন্দ্র । তখন তো চাহিয়াছিলে । আশা অত্যন্ত পীড়িত হইয়া কহিল, “তুমি তো জান, কেন চাহিয়াছিলাম।” মহেন্দ্র । আমাকে ছাড়িয়া তোমার মাসির কাছে বোধ হয় বেশ সুখে থাকিতে । আশা কহিল, “কখনো না। আমি সুখের জন্য যাইতে চাহি নাই।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আমি সত্য বলিতেছি চুনি, তুমি আর-কাহাকেও বিবাহ করিলে ঢের বেশি সুখী হইতে পারিতে ।” শুনিয়া আশা চকিতের মধ্যে মহেন্দ্রের বক্ষ হইতে সরিয়া গিয়া, বালিশে মুখ ঢাকিয়া, কাঠের মতো আড়ষ্ট হইয়া রহিল- মুহূর্তপরেই তাহার কান্না আর চাপা রহিল না। মহেন্দ্ৰ তাহাকে সাস্তুনা দিবার জন্য বক্ষে তুলিয়া লইবার চেষ্টা করিল, আশা বালিশ ছাড়িল না। পতিব্ৰতার এই অভিমানে মহেন্দ্ৰ সুখে গর্বে ধিককারে ক্ষুব্ধ হইতে লাগিল। যে-সব কথা ভিতরে-ভিতরে আভাসে ছিল, সেইগুলা হঠাৎ স্পষ্ট কথায় পরিস্ফুট হইয়া সকলেরই মনে একটা গোলমাল বাধাইয়া দিল। বিনোদিনী মনে মনে ভাবিতে লাগিল- আমন স্পষ্ট অভিযোগের বিরুদ্ধে বিহারী কেন কোনো প্ৰতিবাদ করিল না। যদি সে মিথ্যা প্ৰতিবাদও করিত, তাহা হইলেও যেন বিনোদিনী একটু খুশি হইত। বেশ হইয়াছে, মহেন্দ্ৰ বিহারীকে যে-আঘাত করিয়াছে, তাহা তাহার প্রাপ্যই ছিল। বিহারীর মতো অমন মহৎ লোক কেন আশাকে ভালোবাসিবে। এই আঘাতে বিহারীকে যে দূরে লইয়া গেছে, সে যেন ভালোই হইয়াছে— বিনোদিনী যেন নিশ্চিন্ত হইল। কিন্তু বিহারীর সেই মৃত্যুবাণাহত রক্তহীন পাংশু মুখ বিনোদিনীকে সকল কর্মের মধ্যে যেন অনুসরণ করিয়া ফিরিল। বিনােদিনীর অন্তরে যে সেবাপরায়ণা নারীপ্ৰকৃতি ছিল, সে সেই আর্ত মুখ দেখিয়া কাদিতে লাগিল। রুগণ শিশুকে যেমন মাতা বুকের কাছে দোলাইয়া বেড়ায়, তেমনি সেই আতুর মূর্তিকে বিনোদিনী আপনি হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়া দোলাইতে লাগিল; তাহাকে সুস্থ করিয়া সেই মুখে আবার রক্তের রেখা, প্ৰাণের প্রবাহ, হাস্যের বিকাশ দেখিবার জন্য বিনোদিনীর একটা অধীর ঔৎসুক্য জন্মিল। r দুই-তিন দিন সকল কর্মের মধ্যে এইরূপ উন্মনা হইয়া ফিরিয়া বিনোদিনী আর থাকিতে পারিল না। বিনোদিনী একখানি সান্তুনার পত্র লিখিল, কহিল “ঠাকুরপো, আমি তোমার সেদিনকার সেই শুষ্ক মুখ দেখিয়া অবধি প্রাণমনে কামনা করিতেছি, তুমি সুস্থ হও, তুমি যেমন ছিলে তেমনিটি হও— সেই সহজ হাসি আবার কবে দেখিব, সেই উদার কথা আবার কবে শুনিব । তুমি কেমন আছ, আমাকে একটি ছত্র লিখিয়া জানাও। তোমার বিনোদ-বোঠান।”