পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 €, Aኃ রবীন্দ্র-রচনাবলী মহেন্দ্ৰ কহিল, “খাবার সময় হাজির ছিলে না, এখন খাবার পরে হাজরি পোষাইয়া আরো পাওনা বাকি থাকিবে ।” বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “ তোমার হিসাব যেরকম কড়াক্কড়, তোমার হাতে একবার পড়িলে আর উদ্ধার নাই দেখিতেছি।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “হিসাবে যাই থাক, আদায় কী করিতে পারিলাম।” বিনোদিনী কহিল, “আদায় করিবার মতো আছে কী । তবু তো বন্দী করিয়া রাখিয়াছ।” বলিয়া ঠাট্টাকে হঠাৎ গাম্ভীর্যে পরিণত করিয়া ঈষৎ একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । মহেন্দ্রও একটু গম্ভীর হইয়া কহিল, “ভাই বালি, এটা কি তবে জেলখানা।” এমন সময় বেহারিা নিয়মমত আলো আনিয়া টিপাইয়ের উপর রাখিয়া চলিয়া গেল । হঠাৎ চোখে আলো লাগাতে মুখের সামনে একটু হাতের আড়াল করিয়া নতনেত্ৰে বিনোদিনী বলিল, “কী জানি ভাই । তোমার সঙ্গে কথায় কে পরিবে । এখন যাই, কাজ আছে।” মহেন্দ্ৰ হঠাৎ তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “বন্ধন যখন স্বীকার করিয়াছ তখন যাইবে কোথায় ?” বিনোদিনী কহিল, “ছি ছি, ছাড়ো— যাহার পালাইবার রাস্তা নাই, তাহাকে আবার বাধিবার চেষ্টা কেন ।” বিনোদিনী জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া প্ৰস্থান করিল। মহেন্দ্ৰ সেই বিছানায় সুগন্ধ বালিশের উপর পড়িয়া রহিল, তাহার বুকের মধ্যে রক্ত তোলপাড় করিতে লাগিল। নিস্তব্ধ সন্ধ্যা, নির্জন ঘর, নববসন্তের বাতাস দিতেছে, বিনোদিনীর মন যে ধরা দিল-দিল— উন্মাদ মহেন্দ্র আপনাকে আর ধরিয়া রাখিতে পরিবে না, এমনি বোধ হইল। তাড়াতাড়ি আলো নিবাইয়া ঘরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করিল, তাহার উপরে শাসি। তঁমাটিয়া দিল, এবং সময় না হইতেই বিছানার মধ্যে গিয়া শুইয়া পড়িল । এও তো সে পুরাতন বিছানা নহে। চার-পাচখানা তোশকে শয্যাতল পূর্বের চেয়ে অনেক নরম। আবার একটি গন্ধ- সে অগুরুর কি খসখসের, কি কিসের ঠিক বুঝা গেল না। মহেন্দ্র অনেক বার এপাশ-ওপাশ করিতে লাগিল— কোথাও যেন পুরাতনের কোনো-একটা নিদর্শন খুজিয়া পাইয়া তাহা আঁকড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা। কিন্তু কিছুই হাতে ঠেকিল না। রাত্ৰি নটার সময় রুদ্ধ দ্বারে ঘা পড়িল। বিনোদিনী বাহির হইতে কহিল, “ঠাকুরপো, তোমার খাবার আসিয়াছে, দুয়ার খোলো।” তখনই দ্বার খুলিবার জন্য মহেন্দ্ৰ ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া শাসির আগলে হাত লাগাইল। কিন্তু খুলিল না। — মেঝের উপর উপপুড় হইয়া লুটাইয়া কহিল, “না না, আমার ক্ষুধা নাই, আমি খাইব না।” বাহির হইতে উদবিগ্ন কণ্ঠের প্রশ্ন শোনা গেল, “অসুখ করে নি তো ? জল আনিয়া দিব ? কিছু চাই কি ৷” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আমার কিছুই চাই না- কোনো প্রয়োজন নাই।” বিনোদিনী কহিল, “মাথা খাও, আমার কাছে ভাড়াইয়ো না। আচ্ছা, অসুখ না থাকে তো একবার দরজা খোলো ।” মহেন্দ্ৰ সবেগে বলিয়া উঠিল, “না খুলিব না, কিছুতেই না। তুমি যাও।” বলিয়া মহেন্দ্ৰ তাড়াতাড়ি উঠিয়া পুনর্বার বিছানার মধ্যে গিয়া শুইয়া পড়িল এবং অন্তৰ্হিতা আশার স্মৃতিকে শূন্য শয্যা ও চঞ্চল হৃদয়ের মধ্যে অন্ধকারে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল। ঘুম যখন কিছুতেই আসিতে চায় না, তখন মহেন্দ্ৰ বাতি জ্বালাইয়া দোয়াত কলম লইয়া আশাকে চিঠি লিখিতে বসিল । লিখিল, “আশা, আর অধিক দিন আমাকে এক ফেলিয়া রাখিয়ো না। আমার জীবনের লক্ষ্মী তুমি। তুমি না থাকিলেই আমার সমস্ত প্রবৃত্তি শিকল ছিড়িয়া আমাকে কোন দিকে টানিয়া লইতে চায়, বুঝিতে পারি না। পথ দেখিয়া চলিব, তাহার আলো কোথায়— সে আলো