পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 ○br রবীন্দ্র-রচনাবলী শেষ কথাটা বলিয়া ফেলিয়া হঠাৎ আশার লজ্জাবোধ হইল, গাল-দুটি লাল হইয়া উঠিল। অন্নপূর্ণ খুশি হইয়া মনে মনে হাসিলেন— কহিলেন, “তাই বটে, সেদিন মহিন যখন আসিয়াছিল, তোর বালির কথা একবার মুখেও আনে নাই।” আশা দুঃখিত হইয়া কহিল, “ঐ তার দোষ। যাকে ভালোবাসেন না, সে যেন একেবারেই নাই। তাকে যেন একদিনও দেখেন নাই, জানেন নাই, এমনি তার ভাব।” অন্নপূর্ণ শান্ত স্নিগ্ধ হাস্যে কহিলেন, “আবার যাকে ভালোবাসেন মহিন যেন জন্মজন্মান্তর কেবল তাকেই দেখেন এবং জানেন, এ ভাবও তার আছে। কী বলিস, চুনি।” আশা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া চোখ নিচু করিয়া হাসিল। অন্নপূর্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “চুনি, বিহারীর কী খবর বল দেখি। সে কি বিবাহ করিবে না।” মুহুর্তের মধ্যেই আশার মুখ গভীর হইয়া গেল— সে কী উত্তর দিবে ভাবিয়া পাইল না। আশার নিরুত্তর ভাবে অত্যন্ত ভয় পাইয়া অন্নপূর্ণা বলিয়া উঠিলেন, “সত্য বল চুনি, বিহারীর অসুখ-বিসুখ কিছু হয় নি তো ?” বিহারী এই চিরপুত্রহীনা রমণীর স্নেহ-সিংহাসনে পুত্রের মানস-আদৰ্শরূপে বিরাজ করিত। বিহারীকে তিনি সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া আসিতে পারেন নাই, এ দুঃখ প্রবাসে আসিয়া প্ৰতিদিন তাহার মনে জাগিতা। তাহার ক্ষুদ্র সংসারের আর-সমস্তই একপ্রকার সম্পূৰ্ণ হইয়াছে, কেবল বিহারীর সেই গৃহহীন অবস্থা স্মরণ করিয়াই তাহার পরিপূর্ণ বৈরাগ্যচর্চার ব্যাঘাত ঘটে। আশা কহিল, “মাসি, বিহারী-ঠাকুরপোর কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না।” অন্নপূর্ণ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন বল দেখি।” আশা কহিল, “ সে আমি বলিতে পারিব না।” বলিয়া ঘর হইতে উঠিয়া গেল । অন্নপূর্ণা চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন, “আমন সোনার ছেলে বিহারী, এরই মধ্যে তাহার কি এতই বদল হইয়াছে যে, চুনি আজ তাহার নাম শুনিয়া উঠিয়া যায়। অদৃষ্টেরই খেলা। কেন তাহার সহিত চুনির বিবাহের কথা হইল, কেনই-বা মহেন্দ্ৰ তাহার হাতের কাছ হইতে চুনিকে কাডিয়া লইল । অনেক দিন পরে আজ আবার অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া জল পড়িল— মনে মনে তিনি কহিলেন, ‘আহা, আমার বিহারী যদি এমন-কিছু করিয়া থাকে যাহা আমার বিহারীর যোগ্য নহে, তবে সে তাহা অনেক দুঃখ পাইয়াই করিয়াছে, সহজে করে নাই।” বিহারীর সেই দুঃখের পরিমাণ কল্পনা করিয়া অন্নপূর্ণার বক্ষ ব্যথিত হইতে লাগিল । সন্ধার সময় যখন অন্নপূর্ণা আহ্নিকে বসিয়াছেন, তখন একটা গাড়ি আসিয়া দরজায় থামিল, এবং সহিস বাড়ির লোককে ডাকিয়া রুদ্ধ দ্বারে ঘা মারিতে লাগিল। অন্নপূর্ণ পূজাগৃহ হইতে বলিয়া উঠিলেন, “ঐ যা, আমি একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিলাম, আজ কুঞ্জর শাশুড়ির এবং তার দুই বোনঝির এলাহাবাদ হইতে আসিবার কথা ছিল। ঐ বুঝি তাহারা আসিল। চুনি, তুই একবার আলোটা লইয়া আশা লণ্ঠন-হাতে দরজা খুলিয়া দিতেই দেখিল, বিহারী দাড়াইয়া। বিহারী বলিয়া উঠিল, “এ কী বোঠান, তবে যে শুনিলাম তুমি কাশী আসিবে না।” আশার হাত হইতে লণ্ঠন পড়িয়া গেল। সে যেন প্ৰেতিমূর্তি দেখিয়া এক নিশ্বাসে দোতলায় ছুটিয়া অন্নপূর্ণা পূজার আসন হইতে চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “কাহাকে চুনি, কাহাকে।” আশা কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো এখানেও আসিয়াছেন।” বলিয়া সে পাশের ঘরে গিয়া দ্বার রোধ করিল। বিহারী নীচে হইতে সকল কথাই শুনিতে পাইল। সে তখনই ছুটিয়া যাইতে উদ্যত— কিন্তু অন্নপূর্ণ পূজাহিক ফেলিয়া যখন নামিয়া আসিলেন, তখন দেখিলেন, বিহারী দ্বারের কাছে মাটিতে