পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 S অন্নপূর্ণ আলো আনেন নাই। অন্ধকারে তিনি বিহারীর মুখের ভাব দেখিতে পাইলেন না, বিহারীও তাহাকে দেখিতে পাইল না। অন্নপূর্ণ কহিলেন, “ বেহারী!” হায়, সেই চিরদিনের স্নেহসুধাসিক্ত কণ্ঠস্বর কোথায়। এ কষ্ঠের মধ্যে যে কঠিন বিচারের বজধ্বনি প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে। জননী অন্নপূর্ণা, সংহার-খড়গ তুলিলে কার পরে। ভাগ্যহীন বিহারী যে আজ অন্ধকারে তোমার মঙ্গলাচরণাশ্রয়ে মাথা রাখিতে আসিয়াছিল। বিহারীর অবশ্য শরীর আপাদমস্তক বিদ্যুতের আঘাতে চকিত হইয়া উঠিল, কহিল, “কাকীমা, আর নয়, আর একটি কথাও বলিয়ো না। আমি চলিলাম।” বলিয়া বিহারী ভূমিতে মাথা রাখিয়া প্ৰণাম করিল, অন্নপূর্ণ পা-ও স্পর্শ করিল না । জননী যেমন গঙ্গাসাগরে সস্তান বিসর্জন করে, অন্নপূর্ণা তেমনি করিয়া বিহারীকে সেই রাত্রের অন্ধকারে নীরবে বিসর্জন করিলেন, একবার ফিরিয়া ডাকিলেন না । গাড়ি বিহারীকে লইয়া দেখিতে দেখিতে অদৃশ্য হইয়া গেল । সেই রাত্রেই আশা মহেন্দ্ৰকে চিঠি লিখিল “বিহারী-ঠাকুরপো হঠাৎ আজ সন্ধ্যাবেলায় এখানে আসিয়াছিলেন । জেঠামশায়রা কবে কলিকাতায় ফিরিবেন, ঠিক নাই- তুমি শীঘ আসিয়া আমাকে এখান হইতে লইয়া যাও ।” Sb সেদিন রাত্ৰিজাগরণ ও প্ৰবল আবেগের পরে সকালবেলায় মহেন্দ্রের শরীর-মনে একটা অবসাদ উপস্থিত হইয়াছিল। তখন ফায়ুনের মাঝামাঝি, গরম পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। মহেন্দ্ৰ হেলান দিয়া পড়িল। বেলা হইয়া যায়, স্নানে গেল না। রাস্তা দিয়া ফেরিওয়ালা হাকিয়া যাইতেছে। পথে আপিসের গাড়ির শব্দের বিরাম নাই। প্রতিবেশীর নূতন বাড়ি তৈরি হইতেছে, মিস্ত্ৰি-কন্যারা তাহারই ছাদ পিটিবার তালে তালে সমস্বরে একঘেয়ে গান ধরিল । ঈষৎ তপ্ত দক্ষিণের হাওয়ায় মহেন্দ্রের পীড়িত স্নায়ুজাল শিথিল হইয়া আসিয়াছে ; কোনো কঠিন পণ, দুরূহ চেষ্টা, মানস-সংগ্রাম আজিকার এই হালছাড়া গা-ঢালা বসন্তের দিনের উপযুক্ত নহে। “ঠাকুরপো, তোমার আজ হল কী । স্নান করিবে না ? এ দিকে খাবার যে প্ৰস্তুত । ও কী ভাই, শুইয়া যে ! অসুখ করিয়াছে ? মাথা ধরিয়াছে ?” বলিয়া বিনোদিনী কাছে আসিয়া মহেন্দ্রের কপালে शङ निब्ल | মহেন্দ্র অর্ধেক চোখ বুজিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিল, “আজ শরীরটা তেমন ভালো নাই— আজ আর স্নান করিব না।” বিনোদিনী কহিল, “স্নান না কর তো দুটিখানি খাইয়া লও।” বলিয়া পীড়াপীড়ি করিয়া সে মহেন্দ্ৰকে ভোজনস্থানে লইয়া গেল এবং উৎকণ্ঠিত যত্নের সহিত অনুরোধ করিয়া আহার করাইল । আহারের পর মহেন্দ্ৰ পুনরায় নীচের বিছানায় আসিয়া শুইলে, বিনোদিনী শিয়রে বসিয়া ধীরে ধীরে তাহার মাথা টিপিয়া দিতে লাগিল। মহেন্দ্ৰ নিমীলিতচক্ষে বলিল, “ভাই বালি, এখনো তো তোমার খাওয়া হয় নাই, তুমি খাইতে যাও।” বিনোদিনী কিছুতেই গেল না। অলস মধ্যাহ্নের উত্তপ্ত হাওয়ায় ঘরের পর্দা উড়িতে লাগিল এবং প্রাচীরের কাছে কম্পমান নারিকেলগাছের অর্থহীন মর্মর শব্দ ঘরের মধ্যে প্ৰবেশ করিল। মহেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড ক্রমশই দ্রুততর তালে নাচিতে লাগিল এবং বিনোদিনীর ঘন নিশ্বাস সেই তালে মহেন্দ্রের কপালের চুলগুলি কঁপাইতে থাকিল। কাহারও কণ্ঠ দিয়া একটি কথা বাহির হইল না। মহেন্দ্ৰ মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “অসীম বিশ্বসংসারের অনন্ত প্রবাহের মধ্যে ভাসিয়া চলিয়াছি, তরণী ক্ষণকালের