পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SS O রবীন্দ্র-রচনাবলী জন্য কখন কোথায় ঠেকে, তাহাতে কাহার কী আসে যায় এবং কতদিনের জন্যই বা যায় আসে।” শিয়রের কাছে বসিয়া কপালে হাত বুলাইতে বুলাইতে বিহবল যৌবনের গুরুভারে ধীরে ধীরে বিনোদিনীর মাথা নত হইয়া আসিতেছিল ; অবশেষে তাহার কেশাগ্রভাগ মহেন্দ্রের কপোল স্পর্শ করিল। বাতাসে আন্দােলিত সেই কেশগুচ্ছের কম্পিত মৃদু স্পর্শে তাহার সমস্ত শরীর বারংবার কাপিয়া উঠিল, হঠাৎ যেন নিশ্বাস তাহার বুকের কাছে অবরুদ্ধ হুইয়া বাহির হইবার পথ পাইল না। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া মহেন্দ্ৰ কহিল, “নাঃ, আমার কালেজ আছে, আমি যাই।” বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে না চাহিয়া দাড়াইয়া উঠিল। বিনোদিনী কহিল, “ব্যস্ত হইয়ো না, আমি তোমার কাপড় আনিয়া দিই।” বলিয়া মহেন্দ্রের কলেজের কাপড় বাহির করিয়া আনিল । মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কলেজে চলিয়া গেল, কিন্তু সেখানে কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিল না। পড়াশুনায় মন দিতে অনেকক্ষণ বৃথা চেষ্টা করিয়া সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া আসিল । ঘরে ঢুকিয়া দেখে, বিনোদিনী বুকের তলায় বালিশ টানিয়া লইয়া নীচের বিছানায় উপড়ি হইয়া কী একটা বই পড়িতেছে- রাশীকৃত কালো চুল পিঠের উপর ছড়ানো। বোধ করি বা সে মহেন্দ্রের জতার শব্দ শুনিতে পায় নাই। মহেন্দ্ৰ আস্তে আস্তে পা টিপিয়া কাছে আসিয়া দাড়াইল। শুনিতে পাইল, পড়িতে পড়িতে বিনোদিনী একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । মহেন্দ্ৰ কহিল, “ওগো করুণাময়ী, কাল্পনিক লোকের জন্য হৃদয়ের বাজে খরচ করিয়ো না । কী বিনোদিনী ত্ৰস্ত হইয়া উঠিয়া বসিয়া তাড়াতাড়ি বইখানা অঞ্চলের মধ্যে লুকাইয়া ফেলিল। মহেন্দ্ৰ কাড়িয়া দেখিবার চেষ্টা কবিতে লাগিল। অনেকক্ষণ হাতাহাতি-কাড়াকড়ির পর পরাভূত বিনোদিনীর অঞ্চল হইতে মহেন্দ্র বইখানি ছিনাইয়া লইয়া দেখিল-- বিষবৃক্ষ । বিনোদিনী ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে রাগ করিয়া মুখ ফিরাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। মহেন্দ্রের বক্ষঃস্থল তোলপাড় করিতেছিল। অনেক চেষ্টায় সে হাসিয়া কহিল, “ছি ছি, বডো ফাকি দিলে। আমি ভাবিয়ছিলাম, খুব একটা গোপনীয় কিছু হইবে বা । এত কড়াকড়ি করিয়া শেষকালে কিনা বিষবৃক্ষ বাহির হইয়া পড়িল ।” বিনোদিনী কহিল, “আমার আবার গোপনীয় কী থাকিতে পারে, শুনি ।” মহেন্দ্র ফস করিয়া বলিয়া ফেলিল, “এই মনে করো, যদি বিহারীর কাছ হইতে কোনো চিঠি আসিত ?” নিমেষের মধ্যে বিনোদিনীর চোখে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইল! এতক্ষণ ফুলশর ঘরের কোণে খেলা করিতেছিল, সে যেন দ্বিতীয় বার ভস্মসাৎ হইয়া গেল। মুহুর্তে-প্ৰজ্বলিত অগ্নিশিখার মতো বিনোদিনী উঠিয়া দাড়াইল। মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “মাপ করো, আমার পরিহাস মাপ করো ।” বিনোদিনী সবেগে হাত ছিনাইয়া লইয়া কহিল, “পরিহাস করিতেছ। কাহাকে । যদি তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবার যোগ্য হইতে, তবে তাহাকে পরিহাস করিলে সহা করিতাম। তোমার ছোটাে মন, বন্ধুত্ব করিবার শক্তি নাই, অথচ ঠাট্টা ?” বিনোদিনী চলিয়া যাইতে উদ্যত হইবামাত্ৰ মহেন্দ্ৰ দুই হাতে তাহার পা বেষ্টন করিয়া বাধা দিল । এমন সময়ে সম্মুখে এক ছায়া পড়িল, মহেন্দ্ৰ বিনোদিনীর পা ছাড়িয়া চমকিয়া মুখ তুলিয়া বিহারী স্থির দৃষ্টিপাতে উভয়কে দগ্ধ করিয়া শান্ত ধীর স্বরে কহিল, “অত্যন্ত অসময়ে উপস্থিত হইয়াছি, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকিব না। একটা কথা বলিতে আসিয়াছিলাম। আমি কাশী গিয়াছিলাম, জানিতাম না, সেখানে বউঠাকরুন আছেন। না জানিয়া তাহার কাছে অপরাধী হইয়াছি ; তাহার কাছে যদি কখনো কোনো পাপ স্পর্শ করিয়া থাকে, সেজন্য তাহাকে যেন কখনো কোনো দুঃখ সহ্য করিতে