পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 88S না হয়, তোমার কাছে আমার এই প্রার্থনা।” বিহারীর কাছে দুর্বলতা হঠাৎ প্রকাশ পাইল বলিয়া মহেন্দ্রের মনটা যেন জ্বলিয়া উঠিল। এখন তাহার ঔদার্যের সময় নহে। সে একটু হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরঘরে কলা খাইবার যে গল্প আছে, তোমার ঠিক তাই দেখিতেছি। তোমাকে দোষ স্বীকার করিতেও বলি নাই, অস্বীকার করিতেও বলি নাই ; তবে ক্ষমা চাহিয়া সাধু হইতে আসিয়াছ কেন।” বিহার কাঠের পুতুলের মতো কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া দাড়াইয়া রহিল— তার পরে যখন কথা বলিবার প্রবল চেষ্টায় তাহার ঠোঁট কঁাপিতে লাগিল, তখন বিনোদিনী বলিয়া উঠিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, তুমি কোনো উত্তর দিয়ে না। কিছুই বলিয়ে না। ঐ লোকটি যাহা মুখে আনিল, তাহাতে উহারই মুখে কলঙ্ক লাগিয়া রহিল, সে কলঙ্ক তোমাকে স্পর্শ করে নাই ।” বিনোদিনীর কথা বিহারীর কানে প্ৰবেশ করিল কি না সন্দেহ — সে যেন স্বপ্নচালিতের মতো মহেন্দ্রের ঘরের সম্মুখ হইতে ফিরিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া যাইতে লাগিল । বিনোদিনী তাহার পশ্চাতে গিয়া কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, আমাকে কি তোমার কোনো কথা বালিবার নাই। যদি তিরস্কারের কিছু থাকে, তবে তিরস্কার করো।” বিহারী যখন কোনো উত্তর না করিয়া চলিতে লাগিল, বিনোদিনী সম্মুখে আসিয়া দুই হাতে তাহার দক্ষিণ হাত চাপিয়া ধরিল। বিহার অপরিসীম। ঘূণার সহিত তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া চলিয়৷ গেল। সেই আঘাতে বিনোদিনী যে পড়িয়া গেল তাহা সে জানিতেও পারিল না । পতনশব্দ শুনিয়া মহেন্দ্ৰ ছুটিয়া আসিল । দেখিল, বিনোদিনীর বাম হাতের কনুয়ের কাছে কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে । মহেন্দ্ৰ কহিল, “ইস, এ যে অনেকটা কাটিয়াছে” বলিয়া তৎক্ষণাৎ নিজের পাতলা জামা খানিকটা টানিয়া ছিডিয়া ক্ষতিস্তানে ব্যাণ্ডেজ বাধিতে প্ৰস্তুত হইল । বিনোদিনী তাড়াতাডি হাত সরাইয়া লইয়া কহিল, “না না, কিছুই করিয়ো না, রক্ত পড়িতে দাও।” মহেন্দ্ৰ কহিল, ‘বাধিয়া একটা ঔষধ দিতেছি, তা হইলে আর ব্যথা হইবে না, শীঘ্ৰ সারিয়া বিনোদিনী! সরিয়া গিয়া কহিল, “আমি ব্যথা সারাইতে চাই না, এ কাটা আমার থাক।” মহেন্দ্ৰ কহিল, ‘আজ আধার হইয়া তোমাকে আমি লোকের সামনে অপদস্থ করিয়াছি, আমাকে মাপ করিতে পরিবে কি ৷” বিনোদিনী কহিল, “মাপ কিসের জন্য। বেশ করিয়াছ । আমি কি লোককে ভয় করি। আমি কাহাকেও মানি না। যাহারা আঘাত করিয়া ফেলিয়া চলিয়া যায়, তাহারাই কি আমার সব, আর যাহারা আমাকে পায়ে ধরিয়া টানিয়া রাখিতে চায়, তাহারা আমার কেহই নাহে ?” মহেন্দ্র উন্মত্ত হইয়া গদগদকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী, তবে আমার ভালোবাসা তুমি পায়ে ঠেলিবে না ?” বিনোদিনী কহিল, “মাথায় করিয়া রাখিব । ভালোবাসা আমি জন্মাবধি এত বেশি পাই নাই যে, মহেন্দ্র তখন দুই হাতে বিনোদিনীর দুই হাত ধরিয়া কহিল, “তবে এসো আমার ঘরে । তোমাকে আজ আমি ব্যথা দিয়াছি, তুমিও আমাকে ব্যথা দিয়া চলিয়া আসিয়াছ— যতক্ষণ তাহা একেবারে মুছিয়া না। যাইবে, ততক্ষণ আমার খাইয়া শুইয়া কিছুতেই সুখ নাই।” বিনোদিনী কহিল, “আজ নয়, আজ আমাকে ছাডিয়া দাও। যদি তোমাকে দুঃখ দিয়া থাকি, মাপ করো ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তুমিও আমাকে মাপ করো, নহিলে আমি রাত্রে ঘুমাইতে পারিব না।” বিনোদিনী কহিল, “মাপ করিলাম।” মহেন্দ্র তখনই অধীর হইয়া বিনোদিনীর কাছে হাতে-হাতে ক্ষমা ও ভালোবাসার একটা নিদর্শন