পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 S রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পাইবার জন্য ব্যগ্ৰ হইয়া উঠিল। কিন্তু বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া থমকিয়া দাড়াইল। বিনোদিনী সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিয়া গেলা— মহেন্দ্রও ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া ছাদে বেড়াইতে লাগিল। বিহারীর কাছে হঠাৎ আজ মহেন্দ্র ধরা পডিয়াছে, ইহাতে তাহার মনে একটা মুক্তির আনন্দ উপস্থিত হইল। লুকোচুরির যে-একটা ঘূণ্যতা আছে, একজনের কাছে প্ৰকাশ হইয়াই যেন তাহা চালাইতে চাহি না- কিন্তু আমি ভালোবাসি- আমি ভালোবাসি, সে কথা মিথ্যা নহে।”— নিজের ভালোবাসার গৌরবে তাহার স্পর্ধা এতই বাডিয়া উঠিল যে, নিজেকে মন্দ বলিয়া সে আপন মনে উদ্ধতভাবে গর্ব করিতে লাগিল। নিস্তব্ধ সন্ধ্যাকালে নীরব-জ্যোতিষ্কমণ্ডলী-অধিরাজিত অনন্ত জগতের প্ৰতি একটা অবজ্ঞা নিক্ষেপ করিয়া মনে মনে কহিল, “ যে আমাকে যত মন্দই মনে করে করুক, কিন্তু আমি ভালোবাসি।” বলিয়া বিনোদিনীর মানসী মূর্তিকে দিয়া মহেন্দ্র সমস্ত আকাশ, সমস্ত সংসার, সমস্ত কর্তব্য আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল । বিহারী হঠাৎ আসিয়া আজ যেন মহেন্দ্রের জীবনের ছিপি-আঁটা মসীপাত্র উল্টাইয়া ভাঙিয়া ফেলিল- বিনোদিনীর কালো চোখ এবং কালো চুলের কালি দেখিতে দেখিতে বিস্তৃত হইয়া পূর্বেকার সমস্ত সাদা এবং সমস্ত লেখা লেপিয়া একাকার করিয়া দিল । રે છે পরদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানা হইতে উঠিবামাত্রই একটি মধুর আবেগে মহেন্দ্রের হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল। প্ৰভাতের সূর্যালোক যেন তাহার সমস্ত ভাবনায় বাসনায় সোনা মাখাইয়া দিল। কী সুন্দর পৃথিবী, কী মধুময় আকাশ, বাতাস যেন পুষ্পরেণুর মতো সমস্ত মনকে উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে। সকালবেলায় বৈষ্ণব ভিক্ষুক খোল-করতাল বাজাইয়া গান জুডিয়া দিয়াছিল। দরোয়ান তাড়াইয়া দিতে উদ্যত হইলে মহেন্দ্র দরোয়ানকে ভৎসনা করিয়া তখনই তাহাদিগকে একটা টাকা দিয়া ফেলিল । বেহাবা কেরোসিনের ল্যাম্প লইয়া যাইবার সময় অসাবধানে ফেলিয়া দিয়া চুরমার করিল— মহেন্দ্রের মুখের দিকে তাকাইয়া ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেল। মহেন্দ্র তিরস্কারমাত্র না করিয়া প্ৰসন্নমুখে কহিল, ‘ওরে ওখানটা ভালো করিয়া বঁট দিয়া ফেলিস— যেন কাহারও পায়ে কাচ না ফোটে ।” আজি কোনো ক্ষতিকেই ক্ষতি বলিয়া মনে হইল না । প্ৰেম এতদিন নেপথ্যের আড়ালে লুকাইয়া বসিয়া ছিল— আজি সে সম্মুখে আসিয়া পর্দা উঠাইয়া দিয়াছে।। জগৎসংসারের উপর হইতে আবরণ উঠিয়া গেছে। প্রতিদিনের পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছতা আজ অন্তহিঁত হইল । গাছপালা, পশুপক্ষী, পথের জনতা, নগরের কোলাহল, সকলই আজ অপরূপ । এই বিশ্বব্যাপী নূতনতা এতকাল ছিল কোথায় । মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, আজ যেন বিনোদিনীর সঙ্গে অন্যদিনের মতো সামান্যভাবে মিলন হইবে না। আজ যেন কবিতায় কথা বলিলে এবং সংগীতে ভােব প্রকাশ করিলে, তবে ঠিক উপযুক্ত হয়। আজিকার দিনকে ঐশ্বর্যে সৌন্দর্যে পূৰ্ণ করিয়া মহেন্দ্ৰ সৃষ্টিছাড়া সমাজছাড়া একটা আরব-উপন্যাসের অদ্ভুত দিনের মতো করিয়া তুলিতে চায়। তাহা সত্য হইবে, অথচ স্বপ্ন হইবে— তাহাতে সংসারের কোনো বিধিবিধান, কোনো দায়িত্ব, কোনো বাস্তবিকতা থাকিবে না। আজ সকাল হইতে মহেন্দ্ৰ চঞ্চল হইয়া বেড়াইতে লাগিল, কলেজে যাইতে পারিল না ; কারণ, মিলনের লগ্নটি কখন অকস্মাৎ আবির্ভূত হইবে, তাহা তো কোনো পঞ্জিকায় লেখে না। গৃহকার্যে রত বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে ভাড়ার হইতে, রান্নাঘর হইতে মহেন্দ্রের কানে আসিয়া পৌছিতে লাগিল। আজ তাহা মহেন্দ্রের ভালো লাগিল না— আজি সে বিনোদিনীকে মনে মনে সংসার হইতে বহুদূরে স্থাপন করিয়াছে। সময় কাটিতে চায় না। মহেন্দ্রের মানাহার হইয়া গেল- সমস্ত গৃহকর্মের বিরামে মধ্যাহ্ন নিস্তব্ধ হইয়া আসিল । তবু বিনোদিনীর দেখা নাই। দুঃখে এবং সুখে, অধৈর্যে এবং আশায় মহেন্দ্রের