পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 8\S) মনোযান্ত্রের সমস্ত তারগুলা ঝংকৃত হইতে লাগিল। কালিকার কাড়াকড়ি-করা সেই বিষবৃক্ষখানি নীচের বিছানায় পড়িয়া আছে। দেখিবামাত্র সেই কড়াকড়ির স্মৃতিতে মহেন্দ্রের মনে পুলকাবেশ জাগিয়া উঠিল। বিনোদিনী যে-বালিশ চাপিয়া শুইয়াছিল, সেই বালিশটা টানিয়া লইয়া মহেন্দ্র তাহাতে মাথা রাখিল ; এবং বিষবৃক্ষখানি তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উলটাইতে লাগিল। ক্রমে কখন এক সময় পড়ায় মন লাগিয়া গেল, কখন পাচটা বাজিয়া গেল- ইশ হইল না। ኣ এমন সময় একটি মোরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল ও সন্দেশ এবং রেকবে বরফচিনিসংযুক্ত সুগন্ধি দলিত খরমুজ লইয়া বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিল এবং মহেন্দ্রের সম্মুখে রাখিয়া কহিল, “কী করিতেছ, ঠাকুরপো । তোমার হইল কী। পাচটা বাজিয়া গেছে, এখনো হাতমুখ-ধোয়া কাপড়-ছাড়া হইল না ?” মহেন্দ্রের মনে একটা ধাক্কা লাগিল। মহেন্দ্রের কী হইয়াছে, সে কি জিজ্ঞাসা করিবার বিষয়। বিনোদিনীর সে কি অগোচর থাকা উচিত। আজিকার দিন কি অন্য দিনেরই মতো। পাছে যাহা আশা করিয়াছিল, হঠাৎ তাহার উলটা কিছু দেখিতে পায়, এই ভয়ে মহেন্দ্র গতকল্যাকার কথা স্মরণ করাইয়া কোনো দাবি উত্থাপন করিতে পারিল না । মহেন্দ্ৰ খাইতে বসিল। বিনোদিনী ছাদে-বিছানো রৌদ্রে-দেওয়া মহেন্দ্রের কাপড়গুলি দ্রুতপদে ঘরে বহিয়া আনিয়া নিপুণ হস্তে ভাজ করিয়া কাপড়ের আলমারির মধ্যে তুলিতে লাগিল। বিনোদিনী জোড়হাত করিয়া কহিল, “ দোহাই তোমার, আর যা কর সাহায্য করিয়ো না।” মহেন্দ্ৰ খাইয়া উঠিয়া কহিল, “বটে ! আমাকে অকৰ্মণ্য ঠাওরাইয়াছ! আচ্ছা, আজ আমার পরীক্ষা হউক।” বলিয়া কাপড় ভাজ করিবার বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল। বিনোদিনী মহেন্দ্রের হাত হইতে কাপড় কড়িয়া লইয়া কহিল, “ওগো মশায়, তুমি রাখো, আমার কাজ বাড়াইয়ো না।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “ তবে তুমি কাজ করিয়া যাও, আমি দেখিয়া শিক্ষালাভ করি।” বলিয়া আলমারির সম্মুখে বিনোদিনীর কাছে আসিয়া মাটিতে আসন করিয়া বসিল। বিনোদিনী কাপড় ঝাড়িবার ছলে একবার করিয়া মহেন্দ্রের পিঠের উপর আছড়াইয়া কাপড়গুলি পরিপাটিপূর্বক ভাজ করিয়া আলমারিতে তুলিতে লাগিল। আজিকার মিলন এমনি করিয়া আরম্ভ হইল। মহেন্দ্ৰ প্ৰত্যুষ হইতে যেরূপ কল্পনা করিতেছিল, সেই অপূর্বতার কোনো লক্ষণই নাই। এরূপ ভাবে মিলন কাব্যে লিখিবার, সংগীতে গাহিবার, উপন্যাসে রচিবার যোগ্য নহে। কিন্তু তবু মহেন্দ্ৰ দুঃখিত হইল না, বরঞ্চ একটু আরাম পাইল। তাহার কাল্পনিক আদর্শকে কেমন করিয়া খাড়া করিয়া রাখিত, কিরূপ তাহার আয়োজন, কী কথা বলিত, কী ভাব প্ৰকাশ করিতে হইত, সকলপ্রকার সামান্যতাকে কী উপায়ে দূরে রাখিত, তাহা মহেন্দ্ৰ ঠাওরাইতে পারিতেছিল না— এই কাপড় ঝাড়া ও ভাজ করার মধ্যে হাসিতামাশা করিয়া সে যেন স্বরচিত একটা এমন সময় রাজলক্ষ্মী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মহেন্দ্ৰকে কহিলেন, “মহিন, বউ কাপড় তুলিতেছে, তুই ওখানে বসিয়া কী করিতেছিস।” দিতেছেন।” : মহেন্দ্ৰ কহিল, “বিলক্ষণ। আমি আরো ওঁর কাজে সাহায্য করিতেছিলাম।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার কপাল! তুই আবার সাহায্য করিবি ! জান বউ, মহিনের বরাবর ঐরকম। চিরকাল মা-খুড়ির আদর পাইয়া ও যদি কোনো কাজ নিজের হাতে করিতে পারে।” এই বলিয়া মাতা পরামস্নেহে কর্মে-অপটু মহেন্দ্রের প্রতি নেত্রপাত করিলেন। কেমন করিয়া এই