পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অকৰ্মণ্য একান্ত মাতৃস্নেহাপেক্ষী বয়স্ক সন্তানটিকে সর্বপ্রকার আরামে রাখিতে পরিবেন, বিনোদিনীর সাহিত রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ। এই পুত্ৰসেবা ব্যাপারে বিনোদিনীর প্রতি নির্ভর করিয়া তিনি নিতান্ত নিশ্চিন্ত, পরম সুখী । সম্প্রতি বিনোদিনীর মর্যাদা যে মহেন্দ্ৰ বুঝিয়াছে এবং বিনোদিনীকে রাখিবার জন্য তাহার যত্ব হইয়াছে, ইহাতেও রাজলক্ষ্মী আনন্দিত। মহেন্দ্ৰকে শুনাইয়া শুনাইয়া তিনি কহিলেন, “বউ, আজ তো তুমি মহিনের গরম কাপড় রোদে দিয়া তুলিলে, কাল মহিনের নূতন রুমালগুলিতে উহার নামের অক্ষর সেলাই করিয়া দিতে হইবে । তোমাকে এখানে আনিয়া অবধি যাতু-আদর করিতে পারিলাম না বাছা, কেবল খাটাইয়া মারিলাম।” বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, আমন করিয়া যদি বল। তবে বুঝিব তুমি আমাকে পর ভাবিতেছ।” রাজলক্ষ্মী আদর করিয়া কহিলেন, “আহা মা, তোমার মতো আপন আমি পাব কোথায় ।” বিনোদিনীর কাপড়-তোলা শেষ হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এখন কি তবে সেই চিনির রসটা চড়াইয়া দিব, না, এখন তোমার অন্য কাজ আছে ?” বিনোদিনী কহিল, “না পিসিমা, অন্য কাজ আর কই । চলো, মিঠাইগুলি তৈরি করিয়া আসি গে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “মা, এইমাত্র অনুতাপ করিতেছিলে উহাকে খাটাইয়া মারিতেছি, আবার এখনই কাজে টানিয়া লইয়া চলিলে ?” রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীর চিবুক স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমাদের লক্ষ্মী মেয়ে যে কাজ করিতেই ভালোবাসে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আজি সন্ধ্যাবেলায় আমার হাতে কোনো কাজ নাই, ভাবিয়ছিলাম বালিকে লইয়া একটা বই পড়িব ।” বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, বেশ তো, আজ সন্ধ্যাবেলা আমরা দুজনেই ঠাকুরপোর বই-পড়া শুনিতে আসিব--- কী বল ?” রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, “মহিন আমার নিতান্ত একলা পডিয়াছে, এখন সকলে মিলিয়া তাহাকে ভুলাইয়া রাখা আবশ্যক।” কহিলেন, “তা বেশ তো, মহিনের খাবার তৈরি শেষ কবিয়া আমরা আজ সন্ধ্যাবেলা পড়া শুনিতে আসিব। কী বলিস, মহিন ।” বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একবার দেখিয়া লইল । মহেন্দ্ৰ কহিল, “আচ্ছা।” কিন্তু তাহার। আর উৎসাহ রহিল না । বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে সঙ্গেই বাহির হইয়া গেল । মহেন্দ্র রাগ করিয়া ভাবিল, “আমিও আজ বাহির হইয়া যাইব-— দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিব।” বলিয়া তখনই বাহিরে যাইবার কাপড় পরিল ! কিন্তু সংকল্প কাজে পরিণত হইল না । মহেন্দ্ৰ অনেকক্ষণ ধরিয়া ছাদে পায়চারি করিয়া বেড়াইল, সিঁড়ির দিকে অনেক বার চাহিল, শেষে ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিয়া পড়িল । বিরক্ত হইয়া মনে মনে কহিল, “আমি আজ মিঠাই স্পর্শ না করিয়া মাকে জানাইয়া দিব, এত দীর্ঘকাল ধরিয়া চিনির রস জ্বাল দিলে তাহাতে মিষ্টত্ব থাকে না।” আজ আহারের সময় বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে সঙ্গে করিয়া আনিল । রাজলক্ষ্মী তাহার হাপানির ভয়ে প্রায় উপরে উঠিতে চান না, বিনোদিনী তাহাকে অনুরোধ করিয়াই সঙ্গে আনিয়াছে। মহেন্দ্ৰ অত্যন্ত গভীর মুখে খাইতে বসিল । বিনোদিনী কহিল, “ও কী ঠাকুরপো, আজ তুমি কিছুই খাইতেছ না যে!” রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু অসুখ করে নাই তো ?” বিনোদিনী কহিল, “এত করিয়া মিঠাই করিলাম, কিছু মুখে দিতেই হইবে। ভালো হয় নি বুঝি ? তবে থাক। না না, অনুরোধে পড়িয়া জোর করিয়া খাওয়া কিছু নয়। না না, কাজ নাই।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “ভালো মুশকিলেই ফেলিলে। মিঠাইটাই সব চেয়ে খাইবার ইচ্ছা, লাগিতেছেও ভালো, তুমি বাধা দিলে শুনিব কেন।” দুইটি মিঠাই মহেন্দ্ৰ নিঃশেষপূর্বক খাইল— তাহার একটি দানা, একটু গুড়া পর্যন্ত ফেলিল না। আহারান্তে তিন জনে মহেন্দ্রের শোবার ঘরে আসিয়া বসিলেন। পড়িবার প্রস্তাবটা মহেন্দ্ৰ আর