পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি S 8 ( তুলিল না । রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুই যে কী বই পড়িবি বলিয়াছিলি, আরম্ভ কর—না ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “কিন্তু তাহাতে ঠাকুর-দেবতার কথা কিছুই নাই, তোমার শুনিতে ভালো লাগিবে না ।” ভালো লাগিবে না ! যেমন করিয়া হােক, ভালো লাগিব।ার জন্য রাজলক্ষ্মী কৃতসংকল্প। মহেন্দ্ৰ যদি তুর্কি ভাষাও পড়ে, তাহার ভালো লাগিতেই হইবে । আহা বেচারা মহিন, বউ কাশী গেছে, একলা পডিয়া আছে- তাহার যা ভালো লাগিবে মাতার তাহা ভালো না লাগিলে চলিবে কেন । বিনোদিনী কহিল, “এক কাজ করে—না ঠাকুরপো, পিসিমার ঘরে বাংলা শান্তি-শতক আছে, অন্য বই রাখিয়া আজ সেইটে পড়িয়া শোনাও-না ! পিসিমারও ভালো লাগিবে, সন্ধ্যাটাও কাটিবে ভালো।” মহেন্দ্ৰ নিতান্ত করুণভাবে একবার বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। এমন সময় ঝি আসিয়া খবর দিল, “মা, কায়েত-ঠাকরুন আসিয়া তোমার ঘরে বসিয়া আছেন।” কায়েত-ঠাকরুন রাজলক্ষ্মীর অন্তরঙ্গ বন্ধু ; সন্ধার পর তাহার সঙ্গে গল্প করিবার প্রলোভন সংবরণ করা রাজলক্ষ্মীর পক্ষে দুঃসাধ্য। তবু ঝিকে বলিলেন, “কায়েত-ঠাকরুনকে বল, আজ মহিনের ঘরে আমার একটু কাজ আছে, কাল তিনি যেন অবশ্য-অবশ্য করিয়া আসেন।” মহেন্দ্ৰ তাড়াতাড়ি কহিল, “কোন মা, তুমি তার সঙ্গে দেখা করিয়াই এসো-না।” বিনোদিনী কহিল, “কাজ কী পিসিমা, তুমি এখানে থাকো, আমি বরঞ্চ কায়েত-ঠাকরুনের কাছে গিয়া বসি গে৷ ” রাজলক্ষ্মী প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, “বউ, তুমি ততক্ষণ এখানে বোসো- দেখি, যদি কায়েত-ঠাকরুনকে বিদায় করিয়া আসিতে পারি। তোমরা পড়া আরম্ভ করিয়া দাও— আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো না ।” রাজলক্ষ্মী ঘরের বাহির হইবামাত্ৰ মহেন্দ্ৰ আর থাকিতে পারিল না- বলিয়া উঠিল, “কেন তুমি আমাকে ইচ্ছা করিয়া এমন করিয়া মিছামিছি পীড়ন কর।” বিনোদিনী যেন আশ্চর্য হইয়া কহিল, “সে কী, ভাই! আমি তোমাকে পীড়ন কী করিলাম। তবে কি তোমার ঘরে আসা আমার দোষ হইয়াছে। কাজ নাই, আমি যাই।” বলিয়া বিমর্ষমুখে উঠিবার উপক্ৰম করিল। মহেন্দ্ৰ তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, “আমনি করিয়াই তো তুমি আমাকে দগ্ধ কর।” বিনোদিনী কহিল, “ইস, আমার যে এত তেজ, তাহা তো আমি জানিতাম না। তোমারও তো প্ৰাণ কঠিন কম নয়, অনেক সহ্য করিতে পার। খুব যে ঝলসিয়া-পুড়িয়া গেছ, চেহারা দেখিয়া তাহা উপর চাপিয়া ধরিল। বিনোদিনী “উঃ” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেই মহেন্দ্ৰ তাড়াতাড়ি হাত ছাডিয়া দিয়া কহিল, “লাগিল কি ৷” দেখিল, কাল বিনোদিনীর হাতের যেখানটা কাটিয়া গিয়াছিল, সেইখান দিয়া আবার রক্ত পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্ৰ অনুতপ্ত হইয়া কহিল, “আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম— ভারি অন্যায় করিয়াছি। আজ কিন্তু এখনই তোমার ও-জায়গাটা বাধিয়া ওষুধ লােগাইয়া দিব— কিছুতেই ছাড়িব না।” বিনোদিনী কহিল, “না, ও কিছুই না। আমি ওষুধ দিব না।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “কোন দিবে না।” বিনোদিনী কহিল, “কেন আবার কী। তোমার আর ডাক্তারি করিতে হইবে না, ও যেমন আছে থাক ।” মহেন্দ্র মুহুর্তের মধ্যে গভীর হইয়া গেলা— মনে মনে কহিল, “কিছুই বুঝিবার জো নাই। স্ত্রীলোকের মন!”